ঝড়ের বিকেলে সেই ট্যাক্সিচালক 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাস। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে আইএফআইসি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় যোগ দিয়েছি। চট্টগ্রামে আমার প্রথম যাওয়া। রাস্তাঘাট, লোকজন সব অচেনা। কিছুদিন মেসে থেকে অফিস করলাম। পরে মাকে নিয়ে বাকলিয়ায় পাঁচতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে গেলাম। ব্যাংকে আমাদের কাজের পরিবেশ বেশ ভালো ছিল। ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা কাজের ফাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম। স্থানীয় সহকর্মীদের কাছে ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবের নানা কাহিনি শুনতাম। এসব শুনে মনে মনে ভাবতাম, যদি আর একবার এ রকম ঘূর্ণিঝড় হয়, তাহলে আমি প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারব।

অবশেষে একদিন সেই সুযোগ এল। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমে তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আবহাওয়া দপ্তর চট্টগ্রাম ও উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ঘোষণা করে।

দিনটি ছিল ২৩ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। সকালে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আকাশের অবস্থা দেখে আম্মা অফিসে যেতে বারণ করলেন। কিন্তু আমি ব্যাংকের ছাতা নিয়ে বের হলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে রিকশা নিয়ে অফিসে হাজির হলাম। দুপুর ১২টা নাগাদ বজ্রপাতসহ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে সমগ্র এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের ম্যানেজার সালাম মিয়া সবাইকে চলে যেতে বললেন এবং অসমাপ্ত কাজ পরদিন শুক্রবারে এসে শেষ করতে বলে নিজেও বাসার দিকে রওনা দিলেন। ক্লিয়ারিং ও অ্যাকাউন্টসের কাজ শেষ করতে না পারায় আমি ও আমার সহকারী অলোক, আবেদ ও শফি ব্যাংকে থেকেই কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম; যাতে শুক্রবার ছুটির দিনে অফিসে না আসতে হয়। নিরাপত্তাকর্মীর রেডিও নিয়ে চট্টগ্রাম বেতারে প্রচারিত আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন শুনছিলাম। আর জেনারেটরের আলোয় আমরা চারজন কাজ করছিলাম বেশ দ্রুততার সঙ্গে।

বিশেষ বুলেটিনের ঘোষণা অনুযায়ী বেলা সাড়ে তিনটায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ১৯০ কিলোমিটার গতিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের দিকে এগিয়ে আসছিল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সব কাজ শেষ হলো। আর তখনই বুলেটিনে ঘোষণা এল—ঘূর্ণিঝড়টি সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে আছে এবং সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করতে বলা হলো।

একমুহূর্ত দেরি না করে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চারজন যার যার গন্তব্যে রওনা দিলাম। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে পথ চলব? তাই যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাত, সেই আলোয় কিছুটা এগিয়ে আবার থেমে অপেক্ষা করতাম। বিদ্যুৎ চমকালে আবার হাঁটা শুরু করতাম। এভাবে আমাকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ যেতে হবে। বিদ্যুতের ছেঁড়া তার দেখে পা ফেলতে হচ্ছে নতুবা নির্ঘাত মৃত্যু। ততক্ষণে আমার ঘূর্ণিঝড় দেখার সব সাধ মিটে গেছে। এখন প্রাণ নিয়ে বাসায় ফিরতে পারলেই বাঁচি। বৃষ্টিতে ভিজে থরথর করে কাঁপছি আর একটু একটু করে এগোচ্ছি। কিছুদূর এগোনোর পর সামনের ফাঁকা মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিকট শব্দে একটি তালগাছ ভেঙে পড়ল সামনে। কোথা থেকে ঘরের চালার তিন-চারটি টিন উড়ে এসে পড়ল। ভয়ে দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি পুরোনো দোতলা বাড়ির পরিত্যক্ত গ্যারেজে আশ্রয় নিলাম।

মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রচণ্ড বাতাসে ওই গ্যারেজের বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়ল। ভয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি উচ্চস্বরে দোয়া পড়তে লাগলাম।

এর মধ্যেই ঘটল এক ঘটনা। কোথা থেকে এক বেবিট্যাক্সি এসে থামল আমার সামনে। আমার তো ভূত দেখার মতো অবস্থা। হুডি পরা চালক আমাকে ইশারা করলেন ট্যাক্সিতে উঠতে। আমি হতভম্ব হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আবারও ইশারায় আমাকে উঠতে বললেন। ভয়ে ভয়ে আমি উঠে বসলাম। আমি কোথায় যাব, জানতে চেয়ে তিনি চালাতে শুরু করলেন।

বাতাসের তীব্রতায় ট্যাক্সি এগোতে পারছে না। খানিকটা পথ যাওয়ার পর দেখা গেল, একটি মাঝারি আকারের গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ভাবলাম, এবার সব শেষ। কিন্তু চালক নেমে গিয়ে দ্রুত গাছটি সরিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বাসার সামনে পৌঁছালাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে চালককে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ভাড়া দিতে গেলাম। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই টাকা নেবেন না। হাসি দিয়ে বললেন, বিপদে সাহায্য করতে পেরেই তিনি খুব খুশি হয়েছেন। আর কিছু লাগবে না।

আমি হুডি পরা ওই বেবিট্যাক্সিচালকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাক্সি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। আমি বাসায় মায়ের সান্নিধ্যে ফিরলাম।