কলঙ্কজনক অধ্যায়
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলবেলা আমি বঙ্গভবনে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির শেষ ক্লাসটি নিই। ক্লাস শেষে জেলা গভর্নররা আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের প্রায় সবাই একযোগে প্রতি জেলায় রক্ষীবাহিনীর একটি করে ইউনিট নিয়োগ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তাঁদের বলি, রক্ষীবাহিনীর এত সদস্য আমাদের নেই। যা আছে ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রয়োজনীয় স্থানে নিয়োগ করা হয়েছে। এর পরও তাঁরা আমাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে থাকেন। কারণ, বেশির ভাগ জেলায় তখন সন্ত্রাসী তৎপরতা আবার বেড়ে গিয়েছিল। বাকশালের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। এতে তাঁদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। তখনই সর্বত্র রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করা সম্ভব নয়—এ কথা তাঁদের বোঝাতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তারপর সন্ধ্যাবেলা আমি অফিসে চলে আসি। ইতিমধ্যে সাভার রক্ষী প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে লিডার এ কে এম নুরুল হোসেন, মঈন উদ্দিন চৌধুরী, দীপককুমার হালদার, সিরাজুল হক দেওয়ান ও সাহেব আলী মিয়া তাঁদের অধীন রক্ষী সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে টহল দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরকালে যাতে কোনো ধরনের অঘটন না ঘটে, সব অনুষ্ঠান যাতে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়।
রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আমি অফিসে ছিলাম। এরপর আমি অফিস থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই। সেখানে টহলরত রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। কোথাও কোনো গন্ডগোলের আভাস না পেয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত আমার স্ত্রী ডা. সাঈদা খানকে সঙ্গে নিয়ে আসাদ গেট এলাকায় বাসায় ফিরি। এরপর রাতের খাবার খেয়ে দ্রুত ঘুমাতে যাই। কারণ, অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য পরদিন সকালে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল।
সকাল সাড়ে পাঁচটা বা পৌনে ছয়টা হবে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনে আমি তো হতভম্ব। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শহীদ, মনির (শেখ মনি) বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখ তো, কী করা যায়?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, ‘স্যার, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ বঙ্গবন্ধু লাইন কেটে দেওয়ামাত্র আমি আমাদের ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত রক্ষী কর্মকর্তার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাদের যাঁরা প্যাট্রোল ডিউটিতে ছিলেন, তাঁদের তাড়াতাড়ি ধানমন্ডি এলাকায় শেখ মনির বাসায় যেতে বলি। আমার সরকারি গাড়ি থাকত আমাদের যানবাহন শাখায়। আমাদের যানবাহন শাখা ছিল সংসদ সদস্যদের বাসস্থান এলাকায়। সেখানে ফোন করে কাউকে না পেয়ে আমি ডিউটি রুমে বলি তাড়াতাড়ি আমার জন্য একটা গাড়ি পাঠাতে। এর মধ্যে আমি অফিসে যাওয়ার জন্য কোনো রকমে তৈরি হয়ে নিই। কারণ, বাসা থেকে সরাসরি যোগাযোগ করার কোনো সুবিধা ছিল না।
এ সময় আবার আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। এবার বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহকারী তোফায়েল আহমেদ আমাকে ফোন করে বলেন, ‘রক্ষীবাহিনীর লোকেরা নাকি মনি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, তাড়াতাড়ি দেখো।’ আমি তাঁকে বলি, ‘রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা কেন মনি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করবে!’ ‘আমি দেখছি’ বা ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’—এ রকম কিছু বলেই ফোনটা রেখে আবার ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত কর্মকর্তার কাছে আমি জানতে চাই প্যাট্রোল ডিউটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের শেখ মনির বাড়ি যেতে বলা হয়েছে কি না। উত্তরে তিনি জানান যে মন্ত্রিপাড়ায়ও গোলাগুলি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি, ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটেছে। তাই আর দেরি না করে উপপরিচালক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন মোল্লাকে ফোন করি। তাঁকে অফিসে আসতে বলে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঠিক তখনই পর পর দুটি আর্টিলারি শেল আমার বাসার পাশে সেন্ট যোসেফ স্কুলের দেয়ালে পড়ে। দেয়ালটি ধসে যায়। সেখানে কয়েকজন হতাহত হন। আমার বাসার কাচের জানালায় ফাটল ধরে। ভাগ্যক্রমে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। আমার মনে হলো, হয়তো মিলিটারি ক্যু হয়েছে। আর্টিলারি গোলাগুলো হয়তো আমার বাড়ি লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পাশে পড়েছে। তাই স্ত্রীকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে আমি প্রায় দৌড়ে যাই অফিসের দিকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি অফিসে পৌঁছাই। আমাদের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে টেলিফোনে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে আমি তাড়াতাড়ি অফিসে আসতে বলি এবং সরোয়ারের বাসায় আবার ফোন করি। এবার তাঁকে পাইনি। পরে জেনেছিলাম, সরোয়ারও আমার মতো গাড়ি না পেয়ে দৌড়ে অফিসের দিকে রওনা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে তখন মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা এবং এক কোম্পানি রক্ষী সদস্য ছিলেন। তাঁরা প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতেন। লিডারদের মধ্যে আলিমুজ্জামান জোয়ারদার এবং এ কে নুরুল বাহারকে দ্রুত তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিই। আরও দুজন লিডার এন এ রফিকুল হোসেন এবং এম এম ইকবাল আলম প্রশিক্ষণের জন্য প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁরাও প্রস্তুত থাকলেন।
প্যাট্রোল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী মিয়া ধানমন্ডিতে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে গিয়ে আমাকে জানান যে সেনা পোশাক পরা একদল আক্রমণকারী শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে আক্রমণ করে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে সেখান থেকে চলে গেছে। সাহেব আলী আরও জানান, তিনি শুনেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও নাকি হামলা হয়েছে। আমি সাহেব আলীকে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বলি, যাতে ওই বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নূরুজ্জামান ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার আগে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হলে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, জরুরি প্রয়োজনে সফিউল্লাহকে টেলিফোন করতে। তখন কথাটা আমার মনে পড়ে। আমি পরিচালকের লাল টেলিফোনে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করি এবং ঘটনা জানাই। তিনি আমাকে বলেন যে বঙ্গবন্ধু তাঁকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলেছেন। কারণ, সেনা পোশাক পরা কে বা কারা তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করেছে। আমি তাঁর কাছে আমরা কী করব জানতে চাই এবং তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাতে অনুরোধ করি। সফিউল্লাহ আমাকে বললেন, তিনি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে পাচ্ছেন না। এরপর তিনি ফোন রেখে দিলেন।
এ সময় আমাদের উপপরিচালক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন মোল্লা অফিসে উপস্থিত হন। তাঁর মাধ্যমে জানতে পারি, ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাংক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, সেনাবাহিনীর একটা অংশ বিদ্রোহ করেছে এবং তারাই অভ্যুত্থান সংগঠিত করছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিই। সরোয়ার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন। আমরা যখন এসব করছি, তখন লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার দৌড়ে এসে জানান যে রেডিও থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। বুঝতে পারি, আমাদের সামনে মহাসংকট। দেরি না করে আমি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে আবার ফোন করি। তিনি আমাকে বললেন, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং ডিজিএফআইয়ের প্রধান আবদুর রউফ তাঁর সঙ্গে আছেন। আরও বললেন, ‘উই আর গোয়িং টু ডু সামথিং, তোমরা অপেক্ষা করো এবং তৈরি থাকো।’ সরোয়ার ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা অ্যাকশনে যাব। সেনাবাহিনীর প্রধান যদি সঙ্গে থাকেন, তাহলে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে আমরা বিদ্রোহীদের দমন করতে পারব। বিমানবাহিনী কী ভাবছে, তা জানার জন্য আমি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে ফোন করি। তিনি জানান, তিনি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর কাছে যাচ্ছেন। আমরা ভাবলাম, তাঁরা একটা পদক্ষেপ নেবেন।
এর মধ্যে টহল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে ফিরে আসেন। সাহেব আলী সেখানকার যে মর্মস্পর্শী ও রোমহর্ষক চিত্র তুলে ধরলেন, তা বিশ্বাস করা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আরেক টহলদারি দলের লিডার দীপককুমার হালদার প্রধান কার্যালয়ে এসে আমাদের জানালেন, মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে অনেকেই হতাহত। এ সময় আমি উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কী অবস্থা জানতে তাঁকে ফোন করি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফোন ধরার পর তিনি কোনো কথা বললেন না। আমার মনে হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে তিনি যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। আমি সাহস করে তাঁকে বললাম, ‘স্যার, রাষ্ট্রপতি নিহত, এখন উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনার ওপরই সব দায়িত্ব। আপনি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়ে সব বাহিনীর প্রধানকে ফোন করে বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিহত করার আদেশ দিন।’ উত্তরে তিনি জানান, তাঁর ওখানে কোনো স্টাফ নেই। আমি বললাম, ‘আমি তাহলে আপনাকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসি।’ তিনি বললেন, ‘আসো।’ এরপর আমি প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে ফোন করে একই কথা বললাম। তাঁর কণ্ঠে একটু দৃঢ়তা ছিল। খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মনোভাবও ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন।
আমি মনে মনে ভাবলাম, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে যখন পেয়েছি, দেরি না করে তাঁদের কাছে আমার যাওয়া প্রয়োজন। আমি একটি গাড়ি নিয়ে তাঁদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বেরোনোর সময় দেখলাম রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। জীবনের ভয় না করে আমি ট্যাংকের সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম। তখন সময় আনুমানিক সকাল সোয়া ছয়টা। ফার্মগেট হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পতাকা উড়িয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে দুটি পতাকা থাকে। একটি জাতীয় এবং অপরটি তিনি যে অঙ্গরাজ্যের নাগরিক, সেই রাজ্যের পতাকা। এটা আমি জানতাম। ওই গাড়িতে দুটি পতাকাই ছিল। দুটি পতাকা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের গাড়ি। ভেতরে কে ছিল দেখতে পাইনি।
আমার মনে খটকা এবং সন্দেহ হলো যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। কিছুদিন আগে চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আয়েন্দে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার কথা তখন বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। আয়েন্দে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে আমরা অনেকেই ধারণা করেছিলাম, এখানেও এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রসঙ্গে এর আগে এ কথা বলেছি। সেদিন রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংকবহর আর অত সকালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের গাড়ি হোটেল থেকে বের হওয়ার ঘটনা আমাকে ধারণা দিল যে আমরা এক বিরাট ষড়যন্ত্রের শিকার। তখন অবশ্য এর বেশি আর কিছু ভাবার সময় ছিল না।
আমি ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে উপরাষ্ট্রপতির বাড়িতে গেলাম। বাড়ির গেটে পাহারারত পুলিশ জানাল যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে। এ পরিস্থিতিতে কী করব বুঝতে না পেরে আমি উপরাষ্ট্রপতির সরকারি বাড়ির উল্টো দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নানের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি ড্রয়িংরুমে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় তিনিও অনেকটা নির্বাক হয়ে গেছেন বলে আমার মনে হলো। সময় নষ্ট না করে আমি ওই বাড়ি থেকে লাল টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁকে পাইনি। তবে একজন ফোন ধরেছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর আমি চিনতে পারিনি। তিনি জানালেন, এম মনসুর আলী তাঁর একান্ত সচিবের সঙ্গে বাইরে চলে গেছেন। সরকারকে সংগঠিত করে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশা নিয়ে আমি উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের কথামতো গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের না পেয়ে আমি অনেকটা আশাহত ও হতোদ্যম হয়ে পড়ি।
এদিকে আমি যখন মন্ত্রী আবদুল মান্নানের বাসায়, তখন জাতীয় সংসদের হুইপ রাফিয়া আখতার ডলি সেখানে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এই সংবাদ পেয়েই তিনি ওই বাসায় এসেছিলেন। এসেই তিনি কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়েন। আমার কাছে বারবার জানতে চাইলেন, কীভাবে ঘটনাটা ঘটল, কে ঘটাল, বেগম মুজিব ও রাসেলের কী অবস্থা ইত্যাদি। আবদুল মান্নান ও রাফিয়া আখতার ডলি দুজনই বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁদের সব কথার জবাব আমার কাছে তখন ছিল না এবং আমার হাতে কোনো সময়ও ছিল না। ভগ্নহৃদয়ে আমি অতিদ্রুত আমার অফিসে ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে আমাদের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান অফিসে এসে গেছেন। সরোয়ার আর আমি তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। অর্থাৎ এখন আমাদের কী করণীয়। কারণ, সরকার ভেঙে পড়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আত্মগোপনে গেছেন এবং সেনাবাহিনীর প্রধান কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না। আমরা এসব বিষয়ে কয়েক মিনিট আলোচনা করলাম। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা (সরোয়ার ও আমি) প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে সাভার চলে যাব। যদি প্রয়োজন হয়, যমুনা নদী পার হয়ে রংপুরের দিকে যাব। কারণ, রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা প্রতিরোধ গড়তে আমাদের সহায়তা করবেন—এই বিশ্বাস আমাদের ছিল। ইতিমধ্যে সরোয়ার টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। খন্দকার নাজমুল হুদা আমাদের পরিচালক এ এন এম নূরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নাজমুল হুদাও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন।
ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ার মতো কোনো শক্তি রক্ষীবাহিনীর ছিল না। কারণ, তখনো রক্ষী সদস্যদের ঢাকায় রাখার কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। মিরপুরে জমি অধিগ্রহণ করে রক্ষীবাহিনীর স্থায়ী প্রধান কার্যালয় স্থাপন ও রক্ষী সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করার কাজ চলছিল। রক্ষীবাহিনীর যা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল, নিজেদের কাছে রাখার কোনো সুবিধা না থাকায় সেসব অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছিল পিলখানায় বিডিআর অস্ত্রাগারে।
সাভারে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে দুটি রিক্রুট বা প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়ন ছিল। প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ছিল বলে এসব সদস্য কোনো দায়িত্ব পালনের উপযোগী ছিলেন না। শুধু ৪ নম্বর ব্যাটালিয়ন ছিল নিয়মিত। এই ব্যাটালিয়নের বেশির ভাগ কোম্পানি বিভিন্ন জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে মোতায়েন ছিল। ১৩ নম্বর প্রশিক্ষণ ব্যাটালিয়নের কয়েকটি কোম্পানি ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করত। রক্ষীবাহিনীর অন্য নিয়মিত ব্যাটালিয়নগুলো সারা দেশে মোতায়েন ছিল বিভিন্ন দায়িত্বে। ১৪ নম্বর ব্যাটালিয়ন ছিল সাভারে। কিন্তু মাত্র কয়েক দিন আগে লিডার আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে তাদের খুলনায় পাঠানো হয়েছিল।
ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর কোনো ব্যাটালিয়ন ছিল না। সাভার থেকে ১৩ নম্বর ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি এনে ঢাকায় রাখা হয়েছিল। এ কোম্পানি প্রধান কার্যালয়ের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করত। ওই ব্যাটালিয়নের চারটি টহলদল নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অ্যাডজুট্যান্ট লিডার তায়েব উদ্দিন খান ও ডিউটি অফিসার লিডার এ টি এম হালিমকে আমি জানাই যে আমরা দুজন সাভারে আসছি। তাঁরাও যেন তৈরি হতে থাকেন।
সরোয়ার আর আমি বুঝতে পারি, ঢাকা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আমরা ক্রমেই আটকা পড়ে যাচ্ছি এবং আমাদের পর্যাপ্ত ট্রুপস ও অস্ত্র-গোলাবারুদ নেই। তাই কিছুক্ষণ পর সিদ্ধান্তমতো আমরা দুজন একটা জিপ নিয়ে সাভারের দিকে রওনা হই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের মনে হলো, প্রধান কার্যালয় অরক্ষিত রেখে এবং কয়েকজন কর্মকর্তা ও কিছু রক্ষীকে বিপদের মধ্যে ফেলে কাপুরুষের মতো আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা দুজনই আবার ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভেবে যে মরি আর বাঁচি আমরা ঢাকাতেই থাকব এবং একটা ব্যবস্থা করবই। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তা তো করা যাবে না। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন অস্ত্রশস্ত্র। আগেই বলেছি, সেগুলো ছিল পিলখানায়।
প্রধান কার্যালয়ে ফিরেই আমরা সিনিয়র ডেপুটি লিডার হাফিজ উদ্দিনকে রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ একটা ট্রাক দিয়ে পিলখানায় পাঠাই অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে আসতে। এর আগে আমাদের অনুরোধে রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ফোন করে জানান, পিলখানায় মজুত রাখা রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ নেওয়ার জন্য হাফিজ উদ্দিনকে পাঠানো হচ্ছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাফিজ উদ্দিনের কাছে দেওয়ার জন্য খলিলুর রহমানকে তিনি অনুরোধ করেন। কিন্তু খলিলুর রহমান অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া দূরের কথা, তাঁর নির্দেশে হাফিজ উদ্দিনকে পিলখানায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। গেট থেকেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। রক্ষীবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র সেখানে পড়ে থাকে। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিডিআর মহাপরিচালক খলিলুর রহমান আমাদের সহায়তা করবেন না। ফলে আমাদের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্রমে আমাদের জন্য পরিস্থিতি ধোঁয়াটে হয়ে আসে। আমাদের সাংগঠনিক শক্তি তেমন ছিল না। কোনো দিকেই আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে আমি বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর এক খুনি মেজর ফারুক একদল সেনা নিয়ে আমার বাসায় যান। তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান টাঙ্গাইলে আমাদের প্রতিবেশী ও ফারুকের অধীন সেনা কর্মকর্তা নুরুল হক। ফারুক হয়তো আমাকে হত্যা অথবা গ্রেপ্তার করতে আমার বাসায় গিয়েছিলেন। আমাকে বাসায় না পেয়ে আমার বাসা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ফোন করে জানান, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ আমার বাসায় যাওয়ার আগে ফারুক রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার এ এন এম নূরুজ্জামানের বাসাতেও গিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, নূরুজ্জামান তখন বিদেশে ছিলেন। তাঁকে না পেয়ে তিনি হয়তো আমার বাসায় যান।
নূরুজ্জামান ও আমার বাসায় ফারুকের যাওয়ার বিষয়টি আমি সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারিনি, পরে জেনেছি। আরও জেনেছি, সরোয়ার আর আমি যখন সাভারের পথে বেরিয়েছিলাম, তখন ফারুক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসেন। পরিচালকের কক্ষে ঢুকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলতে বলেন। আবুল হাসান খান তাঁকে বলেন, সরকারি আদেশ না এলে তিনি ছবি নামাতে পারবেন না। এ নিয়ে ফারুক আর কিছু না বলে চলে যান। তবে যাওয়ার আগে বলে যান, তাঁদের ট্যাংকের নলগুলো রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তরের দিকে তাক করা আছে। কোনো মুভমেন্ট নেওয়া হলে সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এ সময় পরিচালকের কক্ষের বাইরে উপস্থিত ছিলেন লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার। তিনি ফারুককে আগে থেকেই চিনতেন। ফারুককে দেখামাত্র আলিমুজ্জামান তাঁকে বলেন, ‘আপনি যা করেছেন ঠিক করেন নাই।’ ফারুক উত্তর দেন, ‘তোকে আমি পরে বলব, কেন করেছি।’
পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণহীন দেহ তাঁর বাড়িতে পড়ে আছে চরম অবহেলায়। আর আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না। এটা যে আমাদের জন্য কতটা কষ্টকর ও বেদনাদায়ক ছিল, তা এখন বোঝানোর ভাষা আমার নেই। আমি শুধু ভাবছি, আমাকে যেভাবেই হোক একটা কিছু করতেই হবে। এ সময় মনে পড়ল তাজউদ্দীন আহমদের কথা। তাঁর কথা আমার আগে মনে পড়েনি। কারণ, তিনি সরকারি দায়িত্বে ছিলেন না। বলা যায়, তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। মনে হলো, এই চরম সংকটময় মুহূর্তে তিনি হয়তো আমাদের কোনো বুদ্ধি দিতে পারবেন। আমি তাঁকে ফোন করি। ইতিমধ্যে তিনি ঘটনার কথা শুনেছেন। আমার মনে হলো, তিনিও ভীষণ ব্যথিত। আমরা কী করতে পারি বা আমাদের কী করা উচিত, এ বিষয়ে আমি তাঁর পরামর্শ চাইলাম। তিনি আমাকে দ্রুত উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলতে বললেন। আমি তাঁকে জানালাম, ইতিমধ্যে আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি তাঁদের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তাঁরা বাসা থেকে চলে গেছেন। এটা শুনে তিনি আমাকে বললেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলতে। তিনি আমাকে আরও বললেন, ঘাতকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে সেনাপ্রধানকে প্রয়োজন।
আমি আবার সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে ফোন করলাম। কিন্তু পেলাম না। সরোয়ার ও আমি তাঁর খোঁজে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে বারবার ফোন করি, কিন্তু তাঁকে পাইনি। এর মধ্যে সরোয়ার ছুটিতে থাকা আমাদের উপপরিচালক (সিগন্যাল) সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে তাড়াতাড়ি সদর দপ্তরে চলে আসতে বলেন।
সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, সেনাপ্রধান প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে আছেন। আমরা সেখানে ফোন করি। বহু কষ্টে এবার আমরা কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। তিনি সরোয়ার আর আমাকে ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে যেতে বলেন। আরও জানালেন, তিনিও সেখানে যাচ্ছেন। আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে হয়তো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমি জানতে চাইলাম, আমরা সাদা পোশাকে কীভাবে সেনানিবাসে যাব, আমাদের তো ঢুকতে দেবে না। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা অপেক্ষা করো, আমি একজন অফিসার পাঠাচ্ছি।’ আমরা ধারণা করলাম, ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকেই অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পর ডিজিএফআইয়ের ঢাকা ডিটাচমেন্টের অফিসার-ইন-চার্জ মেজর জিয়াউদ্দিন আহমদ রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে আসেন। তিনি আমাদের বলেন, সেনাবাহিনীর চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) খালেদ মোশাররফ আমাদের সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে পাঠিয়েছেন। তখন সকাল সাড়ে আটটার মতো হবে। আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। জিয়াউদ্দিন আহমদের গাড়িতে চড়ে আমরা তখনই ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে রওনা হলাম। রাস্তা ফাঁকা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে পৌঁছালাম।
ব্রিগেড কমান্ডারের কক্ষে ঢুকেই দেখি, একটা টেবিল ঘিরে খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিলসহ দু-তিনজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা বসে আছেন। ৩০-৩৫ জন সেনা কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের চেহারা দেখে আমরা বুঝতে পারলাম না, তাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষে, না বিপক্ষে। তবে একটা রহস্যজনক নীরবতা লক্ষ করা গেল। ব্রিগেড কমান্ডারের নির্ধারিত চেয়ারে বসে ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তাঁর পাশে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল। টেবিলের অপর পাশে চেয়ার খালি ছিল। তাঁরা সেখানে আমাদের বসতে বললেন। প্রথমেই খালেদ মোশাররফ যা বললেন, তা শুনে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া। তিনি ইংরেজিতে বললেন, ‘শহীদ–সারোয়ার, আই নো ইউ আর প্যাট্রিয়টস, বাট উই হ্যাড ডু ইট বিকজ উই ডু নট ওয়ান্ট দিস কান্ট্রি টু বি আ কিংডম।’ তারপর বাংলায় বললেন, মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে ইত্যাদি। আমরা শুধু জানতে চাইলাম, সেনাপ্রধান কোথায়? খালেদ মোশাররফ জানালেন, ‘তিনি রেডিও স্টেশনে গেছেন।’
যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে গিয়েছিলাম, তা সফল হবে না ভেবে কথা আর বাড়ালাম না। কিছুক্ষণ পর সীমাহীন হতাশা নিয়ে আমরা রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে ফিরে আসি। জিয়াউদ্দিন আহমদই গাড়িতে করে আমাদের পৌঁছে দেন। ফেরার পথে ভাবতে থাকি, খালেদ মোশাররফ আমাদের কী শোনালেন! একবার মনে হলো, হয়তো তাঁর সামনে ঘাতক দলের অনেকে উপস্থিত ছিল, যাদের আমরা চিনতে পারিনি। এ কারণে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিনি হয়তো ওই কথাগুলো বলেছিলেন। এমনও তো হতে পারে, তিনি যা বলেছেন তা তিনি সত্যিকার অর্থে বলেননি। তবে এটা ঠিক, দেশের ভয়ানক সন্ধিক্ষণে খালেদ মোশাররফের ওই বক্তব্য আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল।
রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে ফিরে সরোয়ার ও আমি চিন্তা করতে থাকলাম কী করা যায়। পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারলাম, সরকার এবং সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই তাঁদের প্রিয় নেতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হয়েছেন জেনে বিস্মিত, ব্যথিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই দেশের এই চরম মুহূর্তে নিজেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার নিজেরাই ত্যাগ করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। অথচ তাঁদের, বিশেষত উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকার ও দলের হাল ধরে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমনটা ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদ সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে শোকে মুহ্যমান জাতীয় নেতারা (রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত) জাতির এই কঠিন সময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আমাদের মনে হলো, এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে পরীক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে ১৯৭১ সালের মতো আবারও সরকারের হাল ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। আমরাও পেতাম দিকনির্দেশনা।
সূত্র: রক্ষীবাহিনীর সত্য–মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩
আনোয়ার উল আলম: তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ)।