আজ বেগমের জন্মদিন
৭৭ বছর শুরু হলো বেগম–এর। তবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে জানা গেল, বেগম–এর ৭২ বছরের ঠিকানা বদলেছে। ১৬ জুলাই বিকেলে পাটুয়াটুলী পৌঁছে দেখা গেল, ৬৬ নম্বর সাইনবোর্ডে লেখা আছে অন্য এক নাম। আশপাশের বর্ষীয়ান দু–একজন জানালেন, নারিন্দার হলুদ মসজিদের কাছে ৩৮, ৩৯ নম্বর শরৎগুপ্ত লেনে খবর নিতে। সেখানে তত্ত্বতালাশ ছিল রীতিমতো সেনাব্যূহ ভেদ করে বীরচক্রে প্রবেশের মতো। সওগাত পত্রিকার মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের বাড়িটি এখন তাঁর মেয়ে নূরজাহান বেগমের দুই মেয়ের মালিকানায় বিভক্ত। এখানকার ৩৯ নম্বর বাড়িটি বেগম–এর বর্তমান ঠিকানা। যদিও ছাপাখানা বা পত্রিকার পুরোনো একটি সংখ্যাও সেখানে নেই, তবু আশার কথা, বেগম এখনো আছে। প্রতি মাসে একটি করে সংখ্যা প্রকাশিত হয় আগের মতোই।
প্রকাশনার তালিকায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। হাতের কাজ, সেলাই, ছায়াছবির মতো প্রসঙ্গগুলোর এখন আর পাঠক নেই। জনবলসংকট, কাগজের দাম, লেখকসংকটের জন্য এখন এ বিভাগগুলো নিয়ে সাধারণত লেখা প্রকাশ করে না বেগম। তবে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, মেয়েদের স্বাস্থ্যসৌন্দর্য, শিশু মঙ্গল, রান্না নিয়ে লেখা প্রকাশ হয়। একসময় দুর্দান্ত দাপটে নারীদের অন্দরমহলে বেগম পৌঁছে যেত এসব বিষয়ের জোরেই। প্রচ্ছদের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। ক্রাউন সাইজের বেগম–এর প্রচ্ছদ হতো হাতে আঁকা ছবি দিয়ে। অনেক দিন ধরেই প্রচ্ছদ হচ্ছে আলোকচিত্র ব্যবহার করে। বেগম শুধু একটি পত্রিকা নয়, বেগম ছিল বাংলার নারীদের কণ্ঠস্বর। নারী সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছিল মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল ও নূরজাহান বেগমের হাতে এই বেগম পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক বেগম অভিভাবকহীন হয়েছে ২০১৬ সালে নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে। এর পর থেকে পত্রিকাটির দায়িত্বে আছেন তাঁর বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান। ফ্লোরা নাসরিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জন্মদিন উপলক্ষে ১১ ফর্মার একটি সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েক পৃষ্ঠা আছে রঙিন। এবারের সংখ্যায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লেখিকা, নজরুলসংগীতশিল্পী প্রয়াত হুসনা বানু খানমের একটি লেখার সঙ্গে আছে সমকালীন নারী লেখকদের অনেক লেখা।’
১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকা কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। বেগম পত্রিকায় একসময় নিয়মিত লিখতেন বেগম সুফিয়া কামাল, দৌলতুন্নেছা, লায়লা আর্জুমান্দ বানুসহ অনেকে। লেখক তালিকায় পরে সেখানে যুক্ত হয়েছেন মকবুলা মনজুর, রাজিয়া মজিদ, জাহানারা আরজু, রিজিয়া খাতুনসহ বহু গুণীজন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই দেশভাগের আগে উত্তাল সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল বেগম-এর প্রথম সংখ্যা। ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল নারী অধিকারের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের ছবি। ১৯৬০ এবং ১৯৭০–এর দশকে প্রতি সপ্তাহে বেগম পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের মতো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাকযোগে এই পত্রিকা পৌঁছে যেত। বর্তমানে কত কপি করে প্রকাশিত হয়, তা অবশ্য জানাতে রাজি হলেন না বর্তমান সম্পাদক ফ্লোরা নাসরিন খান। পাটুয়াটুলীর দীর্ঘদিনের ঠিকানা বদল সম্পর্কে ফ্লোরা নাসরিন খান বললেন, ‘ওটা দেবোত্তর সম্পত্তি। আমার নানা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন যখন কলকাতা থেকে এসেছিলেন, তখনই লিজ নেওয়া ছিল। নবায়ন করে করে ওখানে পত্রিকার প্রেসটি চলত। এত দিনের স্থাপনা সম্প্রতি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছিল। পলেস্তারা খুলে পড়ছিল। নানা রকম জটিলতার জন্য পাটুয়াটুলীর জায়গাটা আমরা সম্প্রতি ছেড়ে দিয়েছি। এখন বেগম কার্যালয় নারিন্দার শরৎগুপ্ত লেনের ৩৯ নম্বর বাড়ি। বেগম এখনো নিয়মিত প্রকাশিত হয়।’
১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে ‘ঈদসংখ্যা বেগম’ প্রকাশিত হয়েছিল ৬২ জন নারী লেখকের লেখা নিয়ে। যখন ঈদসংখ্যার কথাও কেউ ভাবেনি, তখন নূরজাহান বেগম ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সমাজে নারীদের অগ্রগতি নিয়ে যেভাবে চিন্তা করতেন, ঠিক সে বিষয়গুলোই প্রতিফলিত হতো বেগম পত্রিকায়। ২০১৪ সালের ৫ জুন নিজের জন্মদিনে প্রথম আলোকে নূরজাহান বেগম বলেছিলেন, ‘আমি অন্ধকার যুগে জন্মগ্রহণ করেছি। যে যুগে মেয়েদের অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। সে ধরনের পরিবেশে মুসলমান মেয়েরা প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছে। ফেলে আসা দিনগুলো অনেক কঠিন ছিল। আমরা দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করে গেছি। নারীদের শুধু আন্দোলন করলেই হবে না, উপলব্ধি করতে হবে। পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে আনতে হবে।’
২০১৬ সালে নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে অভিভাবক হারিয়েছে বেগম। তবু এখনো বেগম আছে। জন্মদিনে বেগম–এর জন্য শুভেচ্ছা।