ডলার-সংকট মোকাবিলায় জ্বালানি তেল আমদানিতে বিদেশি জাহাজের পাশাপাশি দেশি জাহাজ ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। সংস্থাটি বলছে, তাদের তিনটি জাহাজ এখন অন্য দেশে ভাড়ায় খাটছে। কিন্তু বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানিতে তাদের জাহাজ ব্যবহার করছে না। তারা বিদেশি জাহাজ ব্যবহার করায় পণ্য পরিবহনের ভাড়া ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাতে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ছে।
অন্যদিকে বিপিসি বলছে, জ্বালানি তেল আমদানি করার মতো সক্ষমতা বিএসসির নেই। তা ছাড়া বিপিসি যাদের কাছ থেকে তেল আমদানি করে, তারাই জাহাজ সরবরাহ করে থাকে। তাই চাইলেও তেল আমদানিতে দেশি জাহাজ ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে বিএসসি বলছে, বিদেশ থেকে পণ্য পরিবহনে ৫০ শতাংশ দেশি জাহাজে করে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ‘বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) ২০১৯’ আইনে তা বলা আছে। কিন্তু এ আইন মানা হচ্ছে না। বিপিসি চাইলে দেশি জাহাজ ব্যবহার করতে পারে।
দুই পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি যুক্তির প্রেক্ষাপটে রোববার আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সেখানে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের থাকার কথা রয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল সভায় সভাপতিত্ব করবেন।
জানতে চাইলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সংস্থা) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডলার-সংকট কাটিয়ে উঠতে বিএসসি চায়, তাদের জাহাজে করে জ্বালানি তেল আমদানি করতে। বিপিসি এখন বিদেশি জাহাজে আমদানি করে থাকে। বিষয়টি সুরাহা করতে আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে।
জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। ডলার-সংকটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানি করতে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। বিদেশি সংস্থার আগের পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
বিপিসি বলছে, বাংলাদেশ বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। সৌদি আরবের সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) ও আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক) থেকে এ তেল কেনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বছরে ৪০ লাখ টন শুধু ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশি জাহাজে করে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেও জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি।
বিপিসি বলছে, চাহিদার পুরোটাই আমদানি করার মতো সক্ষমতা বিএসসির নেই। সরকারি পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে যখন তেল আমদানির সিদ্ধান্ত হয়, তখন সিএফআর বা জাহাজভাড়াসহ পণ্যের আমদানি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তাই এখানে বিএসসির জাহাজে করে তেল আমদানির সুযোগ নেই। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর গড়ে ৫৫ লাখ টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। সেখানে বিএসসির জাহাজের ধারণক্ষমতা খুবই কম। এ জন্য তারা বিএসসির জাহাজে করে তেল আমদানি করে না।
জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক অনুপম বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, যাদের কাছ থেকে তেল কেনা হয়, তারাই জাহাজ ঠিক করে দেয়। তাদের সঙ্গে চুক্তিতে তা-ই থাকে। তা ছাড়া বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করার মতো সক্ষমতা বিএসসির আছে কি না, তা-ও দেখার বিষয়।
এদিকে বিএসসি বলছে, তাদের বহরে বর্তমানে আটটি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি জাহাজ প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার। ট্যাংকারগুলো হচ্ছে এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা, এমটি বাংলার অগ্রদূত ও এমটি বাংলার অগ্রগতি। ট্যাংকারগুলোর প্রতিটির ধারণক্ষমতা ৩৯ হাজার টন। জাহাজগুলোর মাধ্যমে সরকারি পণ্য পরিবহন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বিএসসি বলছে, বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিপিসির তহবিল থেকে বিদেশি জাহাজমালিক নিয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিএসসির উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএসসির তিনটি জাহাজের মাসে দুই লাখ টন জ্বালানি তেল আনার সক্ষমতা আছে। সে হিসাবে বছরে ২৪ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারবে। শতভাগ জ্বালানি তেল আমদানি করার মতো সক্ষমতা বিএসসির নেই, এটা ঠিক। তবে অর্ধেক জ্বালানি তেল বিএসসির জাহাজ দিয়ে আমদানি করতে পারে বিপিসি। তা ছাড়া আইনেও বলা আছে, অর্ধেক পণ্য বিএসসির জাহাজে করে আমদানি করতে। কিন্তু সেটা মানা হচ্ছে না।
বিএসসি বলছে, তাদের তিনটি জাহাজ এখন দেশের বাইরে ভাড়ায় খাটছে। আগামী অক্টোবর ও নভেম্বরের মধ্যে এসব জাহাজ দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে। এসব জাহাজ বসিয়ে রাখলে লোকসান গুনতে হয়। সে জন্য বিদেশে ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিপিসি যদি জ্বালানি তেল অর্ধেক বিএসসির জাহাজে করে আমদানি করে, তাহলে এসব জাহাজ বিদেশে ভাড়া দিতে হয় না। আর বিপিসির ডলার খরচ করতে হয় না। দেশীয় জাহাজ ব্যবহার করে দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধ করতে পারবে।