সরকারি আমলাদের পিএইচডির প্রায়োগিক ক্ষেত্র কোথায়: ফরহাদ মজহার

‘বাংলাদেশে পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার সম্ভাবনা, সংকট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, জনগণের অর্থে বিদেশে গিয়ে সরকারি আমলাদের করা পিএইচডির প্রায়োগিক ক্ষেত্র কোথায়? প্রশাসন সম্পর্কে ধারণা নিতে পিএইচডির প্রয়োজন হলে তাঁরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সেটা করতে পারেন।

আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের আনোয়ার হোসেন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায়  ফরহাদ মজহার এ কথা বলেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সচেতন বিজ্ঞানী ও ভাববৈঠকিরা ‘বাংলাদেশে পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার সম্ভাবনা, সংকট ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করেন।

আলোচনা সভায় ফরহাদ মজহার বলেন, তাঁরা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নন। তাঁরা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। পরাশক্তিগুলো এখন আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে দেশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশির দশক পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামরিক অংশগ্রহণ থাকত। কিন্তু এখন পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন এজেন্সি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত করে। আমলাদের পরিবারসহ বিদেশ ভ্রমণের টিকিট দিলে তাঁরা অনেক কিছু স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত থাকেন।

পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের উত্থাপিত ১০টি দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে ফরহাদ মজহার বলেন, যে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চা গড়ে তুলতে পারে না, তাদের সার্বভৌমত্ব অর্থহীন। আধুনিক রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে পরমাণু ও বিজ্ঞানচর্চায় স্বাধীনতার বিকল্প নেই। ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষকে এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বহুবার জীবন দিতে হয়েছে।

আশির দশক পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামরিক অংশগ্রহণ থাকত। কিন্তু এখন পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন এজেন্সি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত করে।
ফরহাদ মজহার, কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক

রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে বলে মত দেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, জ্ঞান উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এখনো মনোযোগী হওয়া যায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে পরমাণু শক্তি কমিশনের স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণা কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি।

রাষ্ট্রকে গণসার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘জানি না, প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেশ কতটা নিরাপদ। কারণ, জনগণের কাছে প্রধান উপদেষ্টাকে জবাবদিহি করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।’

গত ৮ আগস্ট পুরোনো সংবিধানের অধীনে উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণ করায় চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন,‘ ছাত্ররা যে নতুন সংবিধানের কথা বলছেন, সেটা অর্জিত হলে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাবে। তাই আপনাদের রাজপথের সংগ্রামেও অংশ নিতে হবে।’

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মঞ্জুরা হক। এ সময় তিনি পরমাণু শক্তি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন, বিজ্ঞানীদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি প্রদানের এখতিয়ার পরমাণু শক্তি কমিশনকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের পদমানক্রম নিশ্চিত করাসহ ১০টি দাবি উত্থাপন করেন।

পরমাণু শক্তি কমিশন নিয়ে গত ৫৩ বছরে কেউ ভাবেননি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, পরমাণু শক্তি কমিশনের আগের সেই জৌলুশ এখন মলিন হয়ে গেছে। পাশের দেশ ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের জৌলুশ দূর থেকেও বোঝা যায়।

পরমাণু শক্তি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকাকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের পরমাণু কমিশন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকে। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে সফল হতে পারেনি। কারণ, সরকারি কর্মকর্তারা শুধু সার্টিফিকেট (সনদ) চেনেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ পেয়েও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না পেয়ে সেটা হাতছাড়া করেছেন। জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের এই মানসিকতা কেন? আমলাদের জ্ঞানহীনতার এমন উদাহরণ লজ্জার। কমিশনের তদারকি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

আলোচনা সভায় পরমাণু শক্তি কমিশনের সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চায় অবহেলা দেখা গেছে। পরমাণু শক্তি কমিশনের উত্থাপিত সমস্যা সমাধানের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকা। রাষ্ট্র তার পরমাণু ও বৈজ্ঞানিক উৎপাদনকে প্রাধান্য না দিলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।

সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম সাইফুল্লাহ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সভার প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ রোমেল, পরমাণু শক্তি কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক ফারিয়া নাসরীনসহ কমিশনের বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।