বন্ধুদের কাঁধে চড়ে সুন্দরবন দেখলেন হৃদয়

এভাবেই বন্ধুদের কাঁধে চড়ে সুন্দরবন ঘুরে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারি না। সেই আমি যখন বঙ্গোপসাগরে যাই, তখন ছিলাম নেটওয়ার্কের বাইরে। তবে এক মুহূর্তের জন্যও ভয় পাইনি। বন্ধুরা তাদের কাঁধে চড়িয়ে আমাকে জাহাজ ও নৌকায় তুলেছে। হুইলচেয়ার ঠেলে সুন্দরবনের করমজল, দুবলার চর, মোংলা পোর্টের মতো সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।’

কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় সরকার। তিনি ছোটবেলা থেকে একা হাঁটতে বা চলাফেরা করতে পারেন না। একটি ইলেকট্রিক এবং আরেকটি ম্যানুয়াল হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয় তাঁকে। সেই হৃদয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৭২তম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ১৩ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন যান। হৃদয়সহ মোট ৪৫ জন ঢাকায় ফেরেন ১৬ নভেম্বর রাতে। পরিবারের সদস্যদের ছাড়া এত দূরে এটাই ছিল হৃদয়ের প্রথম ট্যুর।

হৃদয় সরকার জানালেন, ট্যুর তাঁকে সব সময়ই টানত। কিন্তু প্রবেশগম্যতার কথা চিন্তা করে কখনো সাহস পাননি। বন্ধুরা সে কথা জানার পর এবার বলেই দিয়েছিলেন, হৃদয় সুন্দরবন না গেলে তাঁরাও যাবেন না।

হৃদয় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভয় পেয়েছি, ঢাকা শহরেই হুইলচেয়ার নিয়ে চলাফেরা করতে কত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়, সেখানে সুন্দরবনের জঙ্গলে তো আরও অসম্ভব। তবে বিভাগের তানজীম উদ্দীন খান স্যার সাহস দিয়েছেন। আর বন্ধুরা বলেছে, তুই শুধু যাবি, আর সব দায়িত্ব আমাদের। হয়েছেও তাই। আমি শুধু মন ভরে আনন্দ করেছি। এটি আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর এখন আমি বিভাগ থেকে যে সার্ক ট্যুর হবে সেখানেও যাওয়ার সাহস পাচ্ছি। সত্যিই আমার বন্ধুরা অসাধারণ।’

২০১৮ সালে গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন হৃদয় সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুনের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার সূত্রপাত করেছিল। ছবিটি ছিল, বছরটির ২১ সেপ্টেম্বর ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিন বিজয় একাত্তর হল থেকে পরীক্ষার হলে হৃদয়কে কোলে করে নিয়ে যান তার মা সীমা রানি সরকার। ছবিটি এম এ আল মামুন নিজের ফেসবুকে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়।

সুন্দরবন ঘুরতে গিয়ে শিক্ষক-সহপাঠীর সঙ্গে হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

হৃদয় জানালেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তির পর তাঁর বন্ধুরাই সব কাজে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। হৃদয়ের ভাষায় তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলেন, তোকে কে ভাবতে বলেছে? সুন্দরবন ট্যুরেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। বন্ধুরাই সব ভেবেছেন।

হৃদয় বললেন, ২০১৯ সালে বিভাগে ভর্তির পর থেকে শুনে আসছেন, বিভাগে দুটি বড় ট্যুর হয়। একটি হচ্ছে গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পলিটিকস কোর্স শেষ করার পর অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খানের সঙ্গে সুন্দরবন ট্যুর এবং আরেকটি হচ্ছে অষ্টম সেমিস্টার শেষে সার্ক ট্যুর। তবে হৃদয় ধরেই নিয়েছিলেন, এসব ট্যুর তাঁর জন্য নয়। তাই এবার যখন বন্ধুরা তাঁকে যেতে বলেছিলেন তিনি যাবেন না বলে না করে দিয়েছিলেন। একইভাবে হৃদয়ের মা সীমা রানি সরকারও আপত্তি করেছিলেন প্রথমে। তবে মা ও ছেলের কোনো আপত্তিই শেষ পর্যন্ত টেকেনি।

সুন্দরবন ট্যুর থেকে ফিরে হৃদয় শিক্ষক ও বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফেসবুকে ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন। হৃদয় লিখেছেন, তিনি যখন যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি করছিলেন তখন তাঁর বন্ধু এবং ট্যুরের মূল উদ্যোক্তা (অর্গানাইজার) মো. কায়েস আজম বলেছিলেন, ‘তোরে এত বুঝতে কে কইছে? তোরে আমি পিঠে নিয়ে সুন্দরবন দেখাব। তোর হুইলচেয়ার কীভাবে নেওয়া হবে, সেটা আমি বুঝব।’

হৃদয় বলেন, ‘খুলনা ঘাটে পৌঁছানোর পর বন্ধুরা আমাকে হুইলচেয়ারে বসিয়েই নৌকায় এবং নৌকা থেকে আবার জাহাজে তোলে। জাহাজ থেকে আমাকে কায়েসের পিঠে করে নামিয়ে ক্যানেল ক্রজিংয়ের জন্য ঠিকভাবে নৌকায় তোলে। জঙ্গলে যে জায়গাগুলোতে হুইলচেয়ার আটকে যায়, সেগুলোতে বন্ধুরা আমাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে হুইলচেয়ারকে উঁচু করে ঝুলিয়ে আমাকে দিয়ে ট্র্যাকিং করায়। আমাকে খাইয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ বন্ধুরাই করে দিয়েছে।’

বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেন হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

হৃদয়ের বন্ধুদের কথা
হৃদয়ের বন্ধু কায়েস আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি হৃদয়কে বলেছিলাম, তোকে আমরা পিঠে নিয়ে ঘুরব। হয়তো আমি ওকে পিঠে নিয়ে হাঁপিয়ে গেছি, তখন অন্য কোনো বন্ধু এগিয়ে এসে ওকে পিঠে তুলে নিত। জামতলা সমুদ্রসৈকতে নামা ছাড়া হৃদয় সব জায়গায় ঘুরতে পেরেছে। সমুদ্র সৈকতে যখন আমরা নামি, তখন ট্রলারের মাঝি হৃদয়কে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন।’

কায়েস আজম বললেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো বিশেষ করে ‘ইকো ট্যুরিজম’ কেন্দ্রগুলোতে কর্তৃপক্ষকে আর একটু নজর দিতে হবে। কাঠের সেতু বা বিভিন্ন জায়গাগুলোতে ঠিকমতো পরিচর্যা করা হয় না। তাই হৃদয়ের হুইলচেয়ার নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় বিপাকে পড়তে হয়।

হৃদয়ের আরেক বন্ধু মো. বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভাগে ভর্তির পর থেকে হৃদয়কে আমরা কখনোই আলাদা চোখে দেখিনি বা এমন কোনো আচরণ করিনি, যাতে তার মনে হয়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। হৃদয় বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সুন্দরবন ট্যুরের গ্রুপ ছবিতে সবার সামনে হুইলচেয়ারে বসা হৃদয়ের ছবিটা না থাকলে আমাদের মন খারাপ হতো। আমরা বলতে পারতাম না আমাদের ব্যাচের ট্যুর ছিল এটা।’

বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরে দেখেন হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘হৃদয় আমাদের সঙ্গে না থাকলে হয়তো আমরা আরেকটু আরামে ট্যুরটা দিতাম, কিন্তু তা পূর্ণতা পেত না। করমজল, হিরণ পয়েন্টে আমাদের গাইড বলেছিলেন, হৃদয় সঙ্গে গেলে সমস্যা হবে। আমরা বলেছিলাম, যত দূর যাওয়া সম্ভব, হৃদয় ততটুকুই যাবে। পরে পুরো জায়গাতেই হৃদয়কে নিয়ে আমরা ঘুরে আসতে পারি। হৃদয়কে নিয়ে কোনো জায়গায় আটকে গেলে কাউকে কিছু বলার আগেই দেখা যেত সাত থেকে আটজন বন্ধু থেমে গেছে হৃদয়কে সহায়তা করার জন্য।’

হৃদয়ের বিভাগের আরেক বন্ধু নূর নাহার (সুকন্যা) বললেন, ‘হৃদয়কে নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তা হয়নি। হৃদয় পুরোটা সময় খুব মজা করেছে। হৃদয়কে সব সময় যিনি সহায়তা করেন সেই অলক সরকারের পাশাপাশি আমরা বন্ধুরা ছিলাম। হৃদয়ের কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে এ কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি।’

হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মোট ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পেয়ে ৩ হাজার ৭৪০তম হন। প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তির আবেদন করেছিলেন হৃদয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী শুধু দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক-প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবন্ধী কোটা প্রযোজ্য ছিল। ফলে হৃদয় সরকারের ভর্তি নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। তারপর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম হৃদয়ের ভর্তির অনিশ্চয়তার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার এনে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শারীরিক প্রতিবন্ধী হৃদয় সরকার। অন্যদিকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে হৃদয়ের লড়াকু মা সীমা রানি সরকার বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পান।

২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা দিতে বিজয় একাত্তর হল থেকে মা সীমা রানী সরকারের কোলে চড়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলেন হৃদয়। মা-ছেলের এই ছবি সে সময় সাড়া ফেলেছিল
ছবি: সংগৃহীত

সারা রাত ঘুমাতে পারেননি হৃদয়ের মা
হৃদয়ের মা সীমা রানি সরকার মুঠোফোনে বললেন, ‘হৃদয়কে ট্যুরে পাঠাতে ভয় লেগেছে। ঈশ্বরের পরেই হৃদয়ের শিক্ষক ও বন্ধুদের ওপর ভরসা করে হৃদয়কে ট্যুরে যেতে দিতে রাজি হয়েছিলাম। তবে যে রাতে ওরা রওনা দিল, সে রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি।’

সীমা রানি সরকার জানালেন, গত এক বছর ধরে তিনি ঢাকার পাশাপাশি স্বামী, এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া আরেক ছেলেসহ সংসার সামলানোর জন্য নেত্রকোনাতেও থাকছেন। এ ছাড়া তিনি নিজেও চাচ্ছেন হৃদয় যাতে স্বনির্ভর হতে পারে। অলক সরকার নামের একজন হৃদয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে থাকছেন। তিনি আজিমপুরের বাসা থেকে হৃদয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়াসহ যাবতীয় কাজ করছেন। আর কোনো কিছুতে আটকে গেলে হৃদয়ের বন্ধুদের ফোন দিলে তাঁরাই তা করে দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খানের সঙ্গে হৃদয় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

সীমা রানি সরকার বললেন, ‘এই প্রথম হৃদয়কে এত দূরে যাওয়ার অনুমতি দিলাম। হৃদয়ের বন্ধুরা ভরসার জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছে বলেই ওদের সঙ্গে দিয়েছি। হৃদয়ের শিক্ষক নিজে হৃদয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল, হৃদয়ের মতো মানুষদের পাশে শুধু পরিবারের সদস্য নয়, আশপাশের অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ করলেন হৃদয়ের শিক্ষক আর বন্ধুরা।’

হৃদয়ের এই ট্যুর নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চেয়েছি হৃদয় ট্যুরে যাবে, অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরেজমিনে সব দেখে আসবে। কারও কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে তাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ইচ্ছাটাই আসল। ওকে ট্যুরে নিয়ে যাওয়াটা ছিল আমার দায়িত্ব। আর আমার চেয়ে হৃদয়ের বন্ধুরাই সব দায়িত্ব পালন করেছে।’