দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও প্রয়োগ কম

প্রতীকী ছবি

আমাদের দেশে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আমিষের চাহিদার বড় একটা অংশ পূরণ হয় ব্রয়লার মুরগির মাধ্যমে। গত জানুয়ারিতে প্রতি কেজি ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি মার্চে ২৮০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। অযৌক্তিক দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করায় গত ২৩ মার্চ চারটি বড় কোম্পানিকে তলব করেছিল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপর খামার পর্যায়ে মুরগির দাম ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে এই খাতের চারটি বড় কোম্পানি। ব্যাপক সমালোচনার পর কোম্পানিগুলো খামার পর্যায়ে নির্ধারিত দামে মুরগি বিক্রি করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, বাজারে সরবরাহের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও কারসাজি ও পারস্পরিক যোগসাজশে দাম বাড়ানো হয়েছিল।

ব্রয়লার মুরগির মতো এভাবে কারসাজি করে কোনো পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯–এর সরাসরি লঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য প্রতিরোধ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে বিধান করার লক্ষ্যে এই আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(২০)(ক) ধারা অনুযায়ী, কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করা বা করতে প্রস্তাব করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ধারা ৪০ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থাৎ যাঁরা বাজারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কোনো পণ্য বিক্রয় করবেন, তাঁরা আইনত দণ্ডনীয় হবেন। কিন্তু আমাদের দেশে এই আইনে বিচার শেষে সাজা হয়েছে, এ রকম উদাহরণ খুব কম।

সবজির দোকান
ফাইল ছবি

আইনটির ৫ ধারা অনুযায়ী জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি পরিষদ থাকবে। যার সদস্য হবেন ২৩ জন। মহাপরিচালক সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। শুধু জাতীয় কমিটি নয়; জেলা, উপজেলা পর্যায় ও ইউনিয়নে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ কমিটি থাকবে। জাতীয় পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার কমিটি থাকলেও জেলা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটির কার্যক্রমের কথা শোনা যায় না। ২৪ ধারা অনুযায়ী, মহাপরিচালক বা সরকারের কাছ থেকে এই উদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার মনে হয় যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন, তাহলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করতে পারে। কিন্তু মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা ও জরিমানা করা ছাড়া ভোক্তা অধিকার পরিষদের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

কারসাজি বা সিন্ডিকেট করে কেউ যাতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারেন, সে জন্য প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণসংক্রান্ত এমন কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে না, যা বাজারে সেই পণ্যের দাম নির্ধারণ বা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে বা বিস্তারের কারণ ঘটায় কিংবা বাজারে মনোপলি অথবা ওলিগপলি অবস্থার সৃষ্টি করে। ১৬ ধারা অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে বা সেবা প্রদানে অন্যায্য বা বৈষম্যমূলক শর্তারোপ করে বা পণ্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয়ে বৈষম্যমূলক মূল্য বা কৃত্রিমভাবে হ্রাসকৃত মূল্য নির্ধারণ করে, এমন কোনো কর্তৃত্বময় অবস্থার সৃষ্টি করা যাবে না। এই আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তকে আর্থিক জরিমানার বিধান রয়েছে।

ব্রয়লার মুরগি
ফাইল ছবি

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছিলেন, বড় ব্যবসায়ী বা করপোরেট প্রতিষ্ঠাগুলো বাজারে একচেটিয়া অবস্থানের কারণে ব্রয়লার মুরগি বা ডিমের দাম বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই কোম্পানিগুলো প্রচলিত প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করে বাজারে কর্তৃত্বমূলক অবস্থা বজায় রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। কিন্তু এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত প্রতিযোগিতা কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

কৃত্রিম সংকট তৈরি বা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো কিংবা একচেটিয়াভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত মুনাফা করার বিরুদ্ধে আমাদের দেশে একাধিক আইন আছে। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন উপলক্ষে অযৌক্তিকভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়। এর কারণ হলো এসব আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ না থাকায় এসব আইন থাকা না–থাকা সমান কথা।

কাইয়ুম আহমেদ আইনজীবী