এই উপমহাদেশে নারীদের যত ধরনের ক্যানসার হয়, তার মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার অন্যতম বলে মনে করেন স্কয়ার হসপিটালস লিমিটেডের অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। তাঁর মতে, এ ধরনের ক্যানসারে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় সৈয়দ আকরাম হোসেন এ কথা বলেন। জানুয়ারি মাস জরায়ুমুখের ক্যানসার-সম্পর্কিত সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে অনলাইন আলোচনার আয়োজন করা হয়। নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন সৈয়দ আকরাম হোসেন। বাংলাদেশে জরায়ুমুখের ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, ডায়াগনোসিস, রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন তিনি।
গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
শুরুতেই জরায়ুমুখের ক্যানসার সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের উপমহাদেশে নারীদের যত ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে, তার মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার অন্যতম। বাংলাদেশে এর অবস্থান দ্বিতীয়। এটি “হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ইনফেকশন”-এর কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের ক্যানসার তাঁদের বেশি হয়, যাঁরা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘদিন বিশেষ করে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পিল নেন, যাঁদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি আছে, একাধিক যৌনসঙ্গী আছে, ধূমপান করেন, বংশের কারও যদি এ ধরনের ক্যানসার থাকে বা অনেক বেশি গর্ভধারণ করেছেন ইত্যাদি।’ এর উপসর্গ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যৌনমিলনের সময় রক্তপাত হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত রক্তপাত বা দুই মাসিকের মধ্যে রক্তপাত, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব যাওয়া, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা ইত্যাদি। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’
জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘এর কিছু পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে “ভায়া টেস্ট” করা হয়। কিন্তু এটার ফলাফল কল্পস্কোপি বা বায়োপসি না করে নিশ্চিত করা যায় না। এ ছাড়া “প্যাপ্যাসমিয়া” করেও এটা বের করা যায়। এটি ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্রতি তিন বছর পর করা লাগে। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হলো “ডিএনএ” টেস্ট, যা ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে প্রতি পাঁচ বছর পর করা লাগে। এ ছাড়া এমআরই বা সিটিস্ক্যানের মাধ্যমেও জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্ণয় করা যেতে পারে। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্ণয় করতে পারলে বেশির ভাগ রোগীই সুস্থ হতে পারে। তবে বলা হয়ে থাকে, ৬৫ বছরের পরে জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়ে আর স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন নেই।’
এরপর উপস্থাপকের প্রশ্নের জবাবে এ রোগের প্রতিরোধ বিষয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘জরায়ুমুখের ক্যানসারের ভ্যাকসিন রয়েছে। যা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের অনুমোদনে ট্রায়াল দেওয়া হয়। যেখানে দেশের প্রখ্যাত গাইনি-অনকোলজিস্ট প্রফেসর ডা. সাবেরা খাতুনের সঙ্গে আমিও ছিলাম। অল্প কিছু মেয়েকে নিয়ে গবেষণা করি, যা সফল হয়। এ ভ্যাকসিনটা যেকোনো সময় দেওয়া যায়। ৯ বছর থেকেই মেয়েরা দিতে পারে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ডোজের পরিমাণও বাড়ে-কমে। তবে দেখা গেছে, যাদের যৌনমিলন এখনো হয়নি তাদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা বেশি। আজকাল ছেলেদেরও নিতে বলা হয়। কারণ, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসটা যৌনমিলনের সময় ছেলেদের কাছ থেকে মেয়েদের কাছে যায়।’
কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে জরায়ুমুখের ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘এ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে প্রথম চিকিৎসা হলো সার্জারি। এতে কাজ না হলে কেমো এবং রেডিওথেরাপি একসঙ্গে দেওয়া হয়। এটা শেষ হওয়ার পর ব্র্যাকি বা বিকিরণ-থেরাপি দিয়ে থাকি। এ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে রোগী সুস্থ হতে পারে। যেখানে তাদের ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার হার বেশি।’
উপস্থাপক জানতে চান, জরায়ুমুখের ক্যানসারসহ এ ধরনের রোগগুলোর জন্য কোন বিষয় দায়ী? উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘দেশের ৩০ শতাংশ ক্যানসারের জন্য দায়ী তামাক। আরেকটা হলো ভেজাল খাবার, যেমন কোমল পানীয়, অতিরিক্ত চিনি ও লবণ—এগুলো কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।’
জরায়ুমুখের ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘এগুলো প্রতিরোধে দরকার পার্টনারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, আমরা দেখি এ ধরনের রোগীদের ভাই বা বাবা চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসে। স্বামী সেভাবে নিয়ে আসে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নারীরা কাউকে বলতে চায় না। তাই উপসর্গগুলোর একটিও যদি দেখা যায়, কালক্ষেপণ না করে অবশ্যই স্থানীয় গাইনিবিশেষজ্ঞকে দেখানো উচিত।’
বাংলাদেশেই বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসাপদ্ধতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো ভালো কাজ করছে। দেশেই ওষুধ তৈরি করার কারণে এর খরচটা কম পড়ছে। রোগীরাও সামর্থ্যের মধ্যেই পাচ্ছে। আর টেস্টের জন্য যে মেশিনগুলো দরকার হয়, সেগুলোও বাংলাদেশে আছে। তাই এ ধরনের ক্যানসারে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’