মিমি ও তাঁর বোনেরা 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ২০১৭ সালের কথা। রোকেয়া হলে থাকতাম। এক রুমে ছয়জন। একদিন হঠাৎ রাত ১০টায় আব্বা ফোন দিয়ে বললেন, ‘আমাদের মাওলানা সাহেবের মেয়ে, মিমি, তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবে, তোমার কাছে থাকবে। সে খুবই ভালো ছাত্রী, সায়েন্সের স্টুডেন্ট। তার যেন কোনো অযত্ন না হয়।’

আমি আচ্ছা বলে ফোনটা রাখলাম। মাওলানা সাহেব বছর দুই হলো পবিত্র শবে বরাতের রাতে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। আমার রুমে সিনিয়র আপুদের আগে থেকেই দুজন গেস্ট ছিল। রুমের সবাই ছিলেন অসম্ভব উদার মনের। তাঁরা মিমির থাকা নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখালেন। মিমি আমার কাছে এসে ক ও ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিল। মেয়েটা ছিল অসম্ভব মেধাবী, লাজুক ও পর্দানশীন। ও অবশ্য দুটি পরীক্ষাতেই অকৃতকার্য হয়। কারণ, ও তখন মূলত মেডিকেলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মিমি একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায়।

মিমির মা আমাকে কেন জানি অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাঁদের বাসায় যেতে খুবই অনুরোধ করতেন। মিমির এক চাচাতো বোন আমারই বান্ধবী ছিল। তাই ওদের বাড়ি অন্য পাড়ায় হলেও মিমির পরিবারের সবাইকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। একবার শীতের ছুটিতে আমি বাড়ি গেলাম। আমার সঙ্গে মিমির মায়ের রাস্তায় দেখা হয়েছিল। মিমির মাকে আন্টি বলতাম। উনি আমাকে পরদিন দুপুরে খাবারের নিমন্ত্রণ জানালেন। খুবই অনুরোধ করলেন যেতে।

বাড়িতে গেলে সাধারণত আমি ১০টার পর ঘুম থেকে উঠতাম, তাই সকালের খাবার খেতে দুপুর হয়ে যেত। আর দুপুরের খাবার খেতাম সন্ধ্যায়। মাকে জানালাম, আমার দুপুরে দাওয়াত আছে, দুপুরে আমি বাসায় খাব না।

দুপুর ১২টার দিকে আন্টি আমাকে তিন–চারবার ফোন করেছিলেন। আমি গোসলে গিয়েছিলাম, ধরতে পারিনি। ফোনে ব্যালান্স ছিল না, কল ব্যাকও করতে পারিনি। পরে বেলা সাড়ে তিনটায় আমি ওদের বাসায় গেলাম। মিমিরা ছিল চার বোন। মিমি ছিল সবার বড়। ওর বাকি বোনগুলোর বয়স যথাক্রমে ১৫, ১০ ও ৬। আর মিমি ১৭–১৮ বছর বয়সী। বাসায় ঢুকতেই দেখলাম আন্টির ছোট মেয়েটা আমাকে লুকিয়ে দেখেই দৌড় দিল। তারপর তৃতীয় বোনটাও ওর সঙ্গে করে এসে আমাকে উঁকি দিয়ে দেখেই দৌড় দিল। দ্বিতীয় বোনটা আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে মুখটা ভার করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মিমি ছলছল চোখে এসে আমাকে ভেতরে ওর ঘরে নিয়ে গেল। মিমির ঘরে একটা চৌকি, একটা আলনা ও একটা পড়ার টেবিল-চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। আমি চেয়ারে বসলাম। কিন্তু ও কোনো কথা বলছিল না। ওর ছোট বোনগুলো একেকজন করে এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিল। আন্টি জোহরের নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষ করে উনি এসেই বললেন, ‘তুমি এসেছ! আমি ভাবলাম যে তুমি আসবে না।’ এ কথা বলেই হঠাৎ সেজ মেয়েটার চুলির মুঠি ধরে মারা শুরু করলেন। তারপর আমি ওনার হাত থেকে মেয়েটাকে আগে ছাড়ালাম।

আন্টি বললেন, ‘আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম, তুমি ধরো নাই। ও বলল আপু আসবে না, তাই বলে তিন বোনে সব ভাগ করে খেয়ে ফেলেছে।’ আমি আসলে ওই মুহূর্তে কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আন্টি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘মাওলানা সাহেব যা উপার্জন করতেন, সব মেয়েদের ভালো ভালো খাবার খাইয়ে শেষ করে দিতেন। বলতেন, মেয়েরা তো পরের ঘরে চলে যাবে। ওরা মেহমান। ওদের বেশি যত্ন করতে হয়। এইভাবে কোনো সঞ্চয় করেননি। মানুষটা আমাকে নিঃস্ব করে রেখে গেছেন। কিন্তু মেয়েগুলোর ভালো খাওয়ার লোভ যায় নাই।’

আন্টি আবারও বললেন, ‘ওরা অনেক দিন কোনো ভালো খাবার খায়নি, মা। অনেক দিন পর বাসায় ভালো খাবার রান্না হয়েছে। ওরা সবাই ছোট মানুষ। তোমার জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য ওদের হয়নি। ওরা খেয়ে ফেলেছে, মা।’

আন্টি নিজেকে এত লজ্জিত, অসহায় ও অপরাধী ভাবছেন যে আমার সহ্য করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি জানি, উনি অনেক সম্মানী মানুষের স্ত্রী। বললাম, ‘আন্টি, আপনার খারাপ দিনগুলো আল্লাহ একদিন শেষ করবেন আপনার মেয়েদের মাধ্যমেই। ওরা মেহমান না, ওরাই কর্তা হবে, সেই দোয়া করি।’

মিমি এখন মেডিকেল কলেজে পড়ে। ওর মেজ বোনটা পড়ে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সে। অন্য দুটিও পড়াশোনায় ভালো।