‘রিকশাচিত্রের কাজ আমি করতাম, নাম লিখতাম বাবার’

নাসিমা আক্তারের আঁকা একটি রিকশাচিত্রছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

নাসিমা আক্তারের ভাষায়, তাঁর আঁকা ছবি সব সময় দৌড়ে বেড়ায়। অর্থাৎ ছবির চলাচলের ক্ষমতা আছে। ব্যাপারটা অবশ্য এক অর্থে মিথ্যাও নয়। দুই যুগের বেশি সময় ধরে নাসিমা আক্তারের আঁকা শত শত ছবি ব্যবহার হয়েছে রিকশায়।

নাসিমা বলছিলেন, ‘খুঁজলে এখনো অনেক রিকশায় পাওয়া যাবে আমার আঁকা ছবি। রংতুলি দিয়ে একেকটা ছবি আঁকার আনন্দই আলাদা। যতই “ডায়াস” বানায় নেন, একটা ছবি আরেকটার মতো হয় না। রং, টানের ব্যাস কম হয়ই। এ জন্য হাতের কাজ আর কম্পিউটারের কাজের পার্থক্য আছে।’

দুই যুগে কতশত ছবি এঁকেছেন, সে হিসাব অবশ্য নাসিমার নিজের কাছেও নেই। বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েক নারী রিকশাচিত্রশিল্পীর খবর পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে একজন নাসিমা আক্তার। সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নারী রিকশাচিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করার অর্জনও তাঁরই। নাসিমা আক্তারের আরেকটি পরিচয়—তিনি ষাটের দশকের প্রখ্যাত রিকশাচিত্রশিল্পী প্রয়াত আলী নূরের মেয়ে। নাসিমা আক্তারের আরও চার ভাইবোন থাকলেও বাবার পেশাটা ধরে রেখেছিলেন তিনি একা।

এখন রিকশাচিত্রের কাজ হয় কম্পিউটারে। একটা ছবির শত শত কপি। একটু এদিক–সেদিক নাই। আমি কাজ পাই না। তাই চুড়ি তৈরির কাজ করি। রিকশাচিত্র একটা মর্যাদা পাইছে, তাই আপনারা আবার খোঁজখবর নিতেছেন আমাদের।
নাসিমা আক্তার, রিকশাচিত্রশিল্পী আলী নূরের মেয়ে

ঢাকার কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দার কামার্তা গ্রামের বাসিন্দা নাসিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিকশাচিত্রশিল্পীদের মূল্য ছিল একসময়। আমার আব্বু ছেলেমেয়েদের রিকশাচিত্রশিল্পী বানানোর চেষ্টা করেছে। এক ভাই কিছুটা শিখেছিল। কিন্তু পেশাটা আমিই ধরে রাখছিলাম। ছোটবেলা থেকে আব্বুর সাথে বসে থাকতাম ছবি আঁকার সময়।’

দুই মেয়ের সঙ্গে নাসিমা আক্তার
ছবি: প্রথম আলো

ষাটের দশকের নামকরা রিকশাচিত্রশিল্পী আলী নূর বেশি আঁকতেন গ্রামবাংলার ছবি। গাছ, মানুষ, প্রকৃতির সুন্দর কাঠামো দিতে পারতেন এই শিল্পী। আলী নূরের মেয়ে নাসিমা একটি তথ্য দিলেন। বললেন, রিকশাচিত্রে শিল্পীর নাম লেখা থাকে। তবে নাসিমা আক্তারের নাম কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর কারণ বাবার প্রতি সম্মান। প্রথম আলোকে নাসিমা বলেন, ‘আব্বু অসুস্থ হইলে তাঁর সব কাজ আমাকে দিছিলেন। রংতুলি ধরতে না পারার জন্য তাঁর কষ্ট দেখছি আমি। নিজে স্বাধীনভাবে আঁকা শুরু করেও তাঁকে খুশি করতে শিল্পীর নামের জায়গায় লিখলাম আব্বুর নাম। মনে হইল, পারিশ্রমিক আমি পাই। নামটা তাঁর থাকলে মানুষটা এত খুশি হয়! তাই কাজ আমি করতাম, নাম লিখতাম আব্বুর।’

ছোটবেলায় রিকশাচিত্র আঁকা শেখার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন শিল্পী নাসিমা। বললেন, বাবা চক দিয়ে দাগ দিয়ে নকশা করে দিতেন। এরপর মেয়েকে বলতেন দাগের মধ্যে রং বসাতে। নিজে জটিল ছবি আঁকতে আঁকতে মেয়েকে হাতেখড়ি দেন ছোট ছোট নকশার কাজ দিয়ে। একসময় নাসিমার হাতে উঠে আসে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকার মুখের ছবি আঁকার মতো জটিল কাজ। তখনো এগিয়ে আসেন বাবা। ডায়াস করে কয়েকটা কপি বানাতেন। বলতেন আঁকতে আঁকতে একদিন ঠিক হবে। নাসিমা নায়ক–নায়িকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এঁকেছেন নায়ক জসিমের ছবি।

দুজন নারী রিকশাচিত্রশিল্পীকে খুঁজে পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। ব্যতিক্রম পেশায় মেয়েরা বাবার পথ ধরে হেঁটেছেন। দুজনই একসময়ের বিখ্যাত রিকশাচিত্রশিল্পীর সন্তান। আফসোসের ব্যাপার হলো দীর্ঘদিন কাজ করে এ পেশা থেকে দুজনই এখন সরে গিয়েছেন। প্রযুক্তির কারণে যেমন কাজ হারিয়েছেন, একই সঙ্গে আছে শিল্পী হিসেবে সম্মান না পাওয়ার কষ্ট।
আমিনুর রহমান, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক আমিনুর রহমান

রিকশাচিত্রে নায়ক-নায়িকার ছবিতে এত কড়া রং কেন ব্যবহার করা হয় অথবা নায়কদের গালে কেন নায়িকাদের মেকআপের মতো গোলাপি আভা, ঠোঁটে লিপস্টিক দেখা যায়, এসব জানতে চাওয়া হয়েছিল। নাসিমা আক্তার বলেন, ‘মানুষের দেখতে ভালো লাগে আর সহজে চোখে পড়ে। ওইটাকে বলে ফ্লোসোন রং। টার্কিশ নামেও একটা রং ব্যবহৃত হয়। এসব রঙের কাজ ছবি চকচকে করা। সামান্য একটু নিয়ে সাদা রঙের সঙ্গে মিশায়ে তারপর দিতে হয়। তবে অনেক দাম এই রঙের।’

বাবা রিকশাচিত্রশিল্পী আলাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছোট্ট আফরোজা ইসলাম
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

নাসিমা নিজে পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, বাবুবাজার থেকে রং কিনতেন। বেছে বেছে নিতেন নানা মাপের তুলি। এভাবে রিকশাচিত্রের কাজ করেছেন দুই যুগের বেশি সময় ধরে। বললেন, ডেলনা (রিকশার পেছনে থাকে), গদি বা চান্দি, টানা, পর্দা পট্টি, গোল্লা, দুই সাইড, পান বা গোল বোর্ড, পট্টি—এসব মিলে একটা সেট হয় রিকশার। এর বাইরেও আছে চট্টি, পা-দানি, ডিপ, যেগুলোতে শিল্পীকে আঁকতে হয়। এমনও সময় গিয়েছে যখন প্রতি সপ্তাহে চারটি করে সেট বানাতে হয়েছে।

এই শিল্পের প্রতি তাঁর কতখানি নিষ্ঠা ছিল, সে গল্প বললেন আলী নূরের আরেক মেয়ে নাসিমা আক্তারের ছোট বোন নুসরাত জাহান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁদের বাবা আলী নূর ১৬ বছর আগে মারা গিয়েছেন। তিনি শুধু এক মেয়েকেই নিজের রিকশা আর্টের কাজটা শেখাতে পেরেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল ছোটবেলা থেকে মেয়ের আগ্রহের জন্য। এ ছাড়া আরেক ছেলে মোহাম্মদ মঞ্জু, তিনি টুকটাক সাহায্য করতে শিখেছিলেন। সম্প্রতি এই ভাই মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন।

রিকশাচিত্র আঁকছেন আলী নূর (বাঁয়ে) ও তাঁর আঁকা দুটি রিকশাচিত্র
ছবি: নাসিমা আক্তারের সৌজন্যে

কিন্তু গত পাঁচ বছরের বেশি হলো নাসিমা আক্তার আর রিকশাচিত্রের কাজ করছেন না। কারণ হিসেবে প্রথম আলোকে নাসিমা বলেন, ‘এখন রিকশাচিত্রের কাজ হয় কম্পিউটারে। একটা ছবির শত শত কপি। একটু এদিক–সেদিক নাই। আমি কাজ পাই না। তাই চুড়ি তৈরির কাজ করি। রিকশাচিত্র একটা মর্যাদা পাইছে, তাই আপনারা আবার খোঁজখবর নিতেছেন আমাদের।’

নাসিমা আক্তারের অভিযোগ আমলে না নিয়ে উপায় নেই। ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। এর পর থেকে শুরু হয়েছে রিকশাচিত্র নিয়ে অনেক আলোচনা। এরই ধারাবাহিকতায় খুঁজে বের করা হচ্ছে বিস্মৃত রিকশাচিত্রশিল্পীদের।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর রিকশাচিত্রশিল্পী আলাউদ্দিন আহমদের আঁকা একটি রিকশাচিত্র
ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

নাসিমা আক্তার যা-ও আক্ষেপ করতে করতে নিজের কথা বললেন, কিন্তু পুরান ঢাকার রিকশাচিত্রশিল্পী আফরোজা ইসলাম এড়িয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। তাঁকে রুমা নামেই চেনে সবাই। শিল্পীর আঁকা ছবির সঙ্গেও স্বাক্ষর থাকত এ নামেই।

আফরোজার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি আলাউদ্দিন আহমদের সন্তান। পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যে দুজন রিকশাচিত্রশিল্পীর নাম উচ্চারিত হয়, আলাউদ্দিন আহমদ তাঁদের একজন। তিনি ছবিতে স্বাক্ষর করতেন ‘নাজ’ নামে। গুণী এই শিল্পীর কন্যাসন্তানও দুই দশক হেঁটেছেন বাবার পথ ধরে। আফরোজার আঁকা একটি বিখ্যাত ছবি—‘বাঘেরা বসে খাচ্ছে ডাইনিং টেবিল-চেয়ারে’। ছবিটি ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক রিকশায় আঁকা দেখা গিয়েছে।

কিন্তু গত এক দশকের বেশি হলো আফরোজা নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছেন শিল্পকর্ম থেকে। কয়েকবার যোগাযোগের পর আফরোজার হয়ে কথা বললেন তাঁর স্বামী এস এম সাইদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী তার বাবার সঙ্গে থেকে কাজ শিখেছে। অন্তত দুই দশক রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজ করেছে। এখন এ কাজের চাহিদা নাই। এ ছাড়া আমরা থাকি পুরান ঢাকায়। এখানকার পরিবেশও নারীর রিকশাচিত্র করার মতো সমর্থনযোগ্য না।’

সাইদুল ইসলাম আরও বললেন, ‘একসময় আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে গিয়েছি। কিন্তু শিল্পীর কদর না থাকলে সে শিল্প নিয়ে আগ্রহ মরে যায়।’

এই দুই নারী রিকশাচিত্রশিল্পীকে খুঁজে বের করা হয়েছিল ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র নিয়ে ইউনেসকোর কাছে নতুন করে নথি তৈরির সময়। ইউনেসকো থেকে বলা হয়েছিল রিকশাচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারী কর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করতে।

রিকশাচিত্রশিল্পী আফরোজা ইসলাম রুমার আঁকা সেই ছবি—‘বাঘ বসে খাচ্ছে ডাইনিং টেবিলে’
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

এরপর বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বাংলাদেশের নারী রিকশাচিত্রশিল্পীদের খুঁজে বের করেন একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক আমিনুর রহমান সুলতান। তিনি অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র নিয়ে গবেষণার কাজ করছেন।

আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজন নারী রিকশাচিত্রশিল্পীকে খুঁজে পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। ব্যতিক্রম পেশায় মেয়েরা বাবার পথ ধরে হেঁটেছেন। দুজনই একসময়ের বিখ্যাত রিকশাচিত্রশিল্পীর সন্তান। আফসোসের ব্যাপার হলো দীর্ঘদিন কাজ করে এ পেশা থেকে দুজনই এখন সরে গিয়েছেন। প্রযুক্তির কারণে যেমন কাজ হারিয়েছেন, একই সঙ্গে আছে শিল্পী হিসেবে সম্মান না পাওয়ার কষ্ট।’

আরও পড়ুন