দেশে জ্বালানি তেলের পরিশোধন ক্ষমতা বাড়াতে এক দশক আগে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। অর্থের জোগান সংকটের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পটি এত দিন ঝুলে ছিল। তবে সম্প্রতি ডলার-সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার পর প্রকল্পটি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। কারণ, পরিশোধনের সক্ষমতা থাকলে সরকারকে এখন বাড়তি দামে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হতো না। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা প্রকল্পটি অনুমোদনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে নেওয়া প্রকল্পটির নাম ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ২’। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। পুরো টাকাই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বহন করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)।
প্রকল্পটি নিয়ে গত ২৪ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়। সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প পর্যালোচনার পাশাপাশি অনুমোদন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব এই কমিশনের। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা মতামত তুলে ধরেন।
প্রকল্পের বিষয়ে কমিশন বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। যার বেশির ভাগই প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের বাড়তি ব্যয় নির্ধারণ নিয়ে।
তেল পরিশোধনে মূল প্ল্যান্ট নির্মাণের বাইরে পূর্ত কাজে যেসব খরচ ধরা হয়েছে, সেগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ইআরএলকে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল না থাকার কথা বলেছে কমিশন। তারা অন্য দেশ থেকেও তেল আমদানির বিষয়টি পর্যালোচনায় তুলে ধরে।
কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তেল পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্পটি বেশ বড়। এখানে অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন পূর্ত কাজে যে খরচ ধরা হয়েছে, তা যৌক্তিক করার কথা বলা হয়েছে।
অবশ্য ইআরএলের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে বর্তমান বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রকল্পের বিভিন্ন খাতের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে বাড়তি কোনো ব্যয় ধরা হয়নি। তবু কমিশন যেসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে, তার আলোকে খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হবে।
দেশে একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইআরএল তৈরি করা হয় ১৯৬৮ সালে। বিপিসির মাধ্যমে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠানটি শোধন করে।
ইআরএলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা গড়ে ৬৫ লাখ টন।
ইআরএলের বছরে তেল শোধনের সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। নতুন প্রকল্পের পরিশোধনাগারের সক্ষমতা হবে ৩০ লাখ টন। ফলে নতুন পরিশোধনাগার হলে ইআরএলের বছরে তেল শোধনের সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টন। এতে বছরে সাশ্রয় করা যাবে ২৪ কোটি ডলার।
খরচের নানা খাত
বিদ্যমান ‘ইআরএল ১’ প্রকল্পের অবস্থান চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায়। তার পাশেই ‘ইআরএল ২’ প্রকল্প করার কথা।
প্রস্তাব অনুযায়ী, ‘ইআরএল ২’ প্রকল্প এলাকার উন্নয়নে সাময়িক সময়ের জন্য ৫০ একর জমি লিজ নেবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। জমির লিজ বরাদ্দ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। সে জন্য ব্যাংক চার্জ বাবদ খরচ ৪৭২ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ কর্মী গড়তে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সে জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা।
প্রকল্প এলাকার ভেতরে রাস্তা নির্মাণে খরচ ১২৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বিভিন্ন সভায় অংশ নেওয়া, ঠিকাদারের অফিসে যাওয়া, কারখানা পরিদর্শনে যাওয়া বাবদ খরচ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন খরচ ধরা হয়েছে ১১১ কোটি টাকা। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাকাটায় খরচ ৫৮৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় খরচ ধরা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।
কাস্টমস শুল্কে খরচ ৪০৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর বাবদ খরচ দেড় হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
প্রশাসনিক ও আবাসিক এলাকার ভবনের জন্য টেস্টিং ও মান নিয়ন্ত্রণ খরচ ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা।
কমিশনের আপত্তি
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে প্রস্তাবিত খরচ বেশি বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। এ জন্য এসব খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে পুনর্নির্ধারণ করতে বলেছে তারা।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তমন্ত্রণালয় সভায় আমরা বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছি। যেসব খাতে এখনই ব্যয় করার দরকার নেই, তা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।’
ইআরএল যা বলছে
ইআরএলের কর্মকর্তারা বলছেন, জমির লিজ মূল্য ধরা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের বর্তমান জমির মূল্য ধরেই। এত বড় কারিগরি প্রকল্প পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণে জনবল দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার ভেতরে রাস্তা বানানোসহ অন্যান্য খাতের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে।
ইআরএল বলছে, প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ২৮০ কোটি ডলার নির্ধারণ করেছিল ফ্রান্সের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকনিপ। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে তখন প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। পরে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক ভারতের মেসার্স ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল) ব্যয় কমিয়ে ১৮৫ কোটি ডলার নির্ধারণ করে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।
ইআরএলের মহাব্যবস্থাপক রায়হান আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। তবু খরচ কমিয়ে আনতে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। কমিশনের নির্দেশনা মেনে খরচ কমিয়ে যৌক্তিক করা হবে। কমিশন আরও যেসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে, আমরা দ্রুততম সময়ে তার জবাব দেব।’
ইআরএল বলছে, সময়মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। পরিশোধন সক্ষমতার সঙ্গে মজুত ক্ষমতাও বেড়ে তিন গুণ হতো। এতে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি না করে পরিস্থিতি বুঝে অপেক্ষা করার সুযোগ পেত বিপিসি।
অন্যদিকে ইআরএলের এক কর্মকর্তা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেল ভালো। তাই বাইরে অন্য দেশ থেকে তেল আমদানি যৌক্তিক হবে না। বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনকে জানানো হবে।
২৪ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের সভায় উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিভাগে প্রকল্প যাচাই কমিটি চারবার বৈঠক করে ব্যয় নির্ধারণ করেছে। তবু যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করব সরকারি টাকা সাশ্রয় করতে।’