গণিতের আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের ‘গাণিতিক সমস্যা’

শাহজালাল সোহাগ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৯ সালে শুরু হলেও বিশ্বের প্রাক্‌–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় মেধার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অংশ নিচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে শতাধিক দেশের খুদে গণিতবিদদের দুই দিনে নয় ঘণ্টায় ছয়টি নতুন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। সমস্যাগুলো হয় সম্পূর্ণ নতুন।

প্রতিবছর সারা বিশ্বের গণিতবিদ, সমস্যা প্রস্তুতকারী ও গণিত–আগ্রহীরা এসব সমস্যা তৈরি করেন। আয়োজক দেশের একটি কমিটি এগুলো থেকে মোট ৩০টি গাণিতিক সমস্যাকে বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করে, যা থেকে সেই বছরের অলিম্পিয়াডের জন্য ছয়টি সমস্যা বাছাই করা হয়।

২০০৫ সাল থেকে শুরু হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গাণিতিক সমস্যা তৈরি করে তা প্রথমবারের মতো পাঠানো হয় ২০২১ সালে, রাশিয়ায়। সেই বারই প্রকৌশলী শাহজালাল সোহাগের তৈরি করা এমন একটি বীজগণিতের সমস্যা সংক্ষিপ্ত তালিকায় নির্বাচিত হয়। আইএমওর নিয়মানুযায়ী, সংক্ষিপ্ত তালিকার সমস্যাগুলো পরের বছর আইএমওর শেষে প্রকাশিত হয়।

২০২২ সালে নরওয়েতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াডের শেষে গত বারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানেই বীজগণিত ক্যাটাগরির তিন নম্বর সমস্যা হিসেবে শাহজালাল সোহাগের সমস্যাটি প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে শাহজালাল সোহাগের সঙ্গে কথা বলেছেন মুনির হাসান।

শাহজালাল সোহাগ দাউদকান্দি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। তারপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট) থেকে সিএসই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে আলপাইন ডিফাই নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আইটি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রিমোটলি কাজ করছেন।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: আপনার সমস্যা আইএমওর সংক্ষিপ্ত তালিকাতে নির্বাচিত হয়েছে, এটা কখন জেনেছেন?

সোহাগ: এটা ২০২১ সালের আইএমওর পরপরই জানতে পারি। কিন্তু এত দিন এটা গোপন করে রাখতে হয়েছে। কারণ, সমস্যাটি বিভিন্ন দেশের আইএমওতে পাঠানোর জন্য দল বাছাই করার প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: গাণিতিক সমস্যাটি মাথায় এল কীভাবে?

সোহাগ: আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বেশির ভাগ সময় আমি দিয়েছি কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং এবং সমস্যা সমাধানের পেছনে। তখন বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। এরপর আমি প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার জন্যও প্রবলেম তৈরি করেছি। এর মধ্যে দেশ-বিদেশে আমার তৈরি করা ৬০টি প্রবলেম বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২১ সালের ১৯ মে আমি কোড ফোর্সেসের জন্য একটি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় গাণিতিক সমস্যাটি প্রস্তাব করি। কিন্তু সেখানকার প্রবলেম জাজ এন্টন ট্রাইগাব আমাকে বললেন, এটা আইএমওতে পাঠালে ভালো হয়। বলে রাখি, এন্টন ট্রাইগাব আইএমও গোল্ড মেডালিস্ট। তাঁর কাছ থেকে আশা পেয়ে আমি বাংলাদেশের টিম লিডার মাহবুব মজুমদার স্যারকে গাণিতিক সমস্যাটি পাঠাই এবং তিনি নিয়মানুযায়ী, এটা আইএমওতে পাঠান। পরে গাণিতিক সমস্যাটি সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়। গাণিতিক সমস্যা মাথায় আসার ব্যাপারে বলতে গেলে দেখা যায় যে মাঝেমধ্যে সারা দিন গাণিতিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করলেও কোনো ভালো গাণিতিক সমস্যার ধারণা বের করা যায় না। ওই যে আমি ৬০-এর বেশি গাণিতিক সমস্যা বানিয়েছি, কিন্তু গুনলে দেখা যাবে ৫০০–এরও বেশি ধারণা মাথায় এসেছে। বাকিগুলো ভালো ধারণা ছিল না। এই যে এতগুলো গাণিতিক সমস্যার মধ্যে একটি গাণিতিক সমস্যা আইএমওতে পাঠিয়েছি এবং সেটি সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছে।
গাণিতিক সমস্যাটি বীজগণিত ক্যাটাগরিতে নেওয়া হয়েছে। আইএমওর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে ২০২১ সালের ‘শর্টলিস্টেট প্রবলেমের অ্যালজেব্রা ক্যাটাগরির’ তৃতীয় প্রবলেমটি আমার।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: গণিত নিয়ে আগ্রহ কবে থেকে?

সোহাগ: গণিত নিয়ে আগ্রহ আমার সেই প্রাইমারি স্কুল থেকেই, যখন আমার গণিত শিক্ষক বাবা আমাকে গণিত শেখাতেন। গণিতের সমস্যার সমাধান করেই আমার সমস্যা সমাধানের হাতেখড়ি হয়।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: গণিত অলিম্পিয়াডে কখনো অংশ নিয়েছেন?

সোহাগ: আমি কলেজে থাকা অবস্থায় ঢাকা রিজিওনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে তৃতীয় হয়েছিলাম। কিন্তু আমি কোনো ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করিনি। মূলত গুগল ও ইউটিউব থেকেই নিজে নিজে ম্যাথ শিখেছি, যার বেশির ভাগই একাডেমিক বইবহির্ভূত ছিল। কারণ, আমার গণিতের সমস্যা সমাধান করে অনেক মজা লাগতে। এ ছাড়া সাস্টে থাকা অবস্থায় আমি বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ভলান্টিয়ারিং করেছি। মজার বিষয় হচ্ছে, আমি সাস্টে প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় একটি প্রতিযোগিতায় আমার সঙ্গের বন্ধুরা অংশগ্রহণ করলেও আমি তখন তেমন প্রোগ্রামিং পারতাম না বলে অংশ না নিয়ে ভলান্টিয়ারিং করেছি।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: প্রোগ্রামিং কবে থেকে করছেন?

সোহাগ: আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রায় অনেক দিন ডিপ্রেশনে ছিলাম। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম যে ডিপ্রেশনে থাকলে নিজে যা করতে পারতাম সেটাও করতে পারব না, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের প্রায় আট মাস চলে গেছে। কিন্তু তারপরও ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রোগ্রামিং শুরু করি। এরপর বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি এবং এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৫০০–এরও বেশি প্রোগ্রামিং প্রবলেম সমাধান করেছি। এই বছর নভেম্বরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বকাপ খ্যাত আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনাল এবং এটাতে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পেয়েছি একজন কন্টেস্টেন্ট হিসেবে। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: কবে থেকে প্রোগ্রামিং প্রবলেম বানাতে শুরু করেছেন?

সোহাগ: আমি প্রোগ্রামিং প্রবলেম বানাই ২০২০ সাল থেকে। আমি কোড ফোর্সেস, কোড শেফ, হ্যাকারর‌্যাঙ্কসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্ল্যাটফর্মে ষাটের বেশি প্রবলেম বানিয়েছি। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং প্ল্যাটফর্ম কোড ফোর্সেসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো একটি সম্পূর্ণ ডিভিশন ওয়ান প্রবলেম সেট বানিয়েছি।

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: নতুন যারা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা বা গণিত অলিম্পিয়াডে আগ্রহী, তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

সোহাগ: গণিত অনেক মজার। প্রবলেম সলভিং অনেক মজার। তোমরা বিভিন্ন অলিম্পিয়াড এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে দেখ। এটা গেমস খেলার চেয়েও কম মজার কিছু না। গণিত হচ্ছে ম্যাজিক। এই ম্যাজিক কাজে লাগিয়ে তোমরা ভবিষ্যতে নিজেদের জীবনে ম্যাজিক্যাল পরিবর্তন আনতে পারবে। শুধু একটু চেষ্টা করে দেখ?

প্রশ্ন :

মুনির হাসান: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সোহাগ: প্রথম আলোকেও অনেক ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রণ করার জন্য। আশা করি প্রথম আলো গণিতের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যাবে এবং এই কথোপকথনের মাধ্যমে যদি একজনও একটু অনুপ্রাণিত হয়, তাহলেই আমি সার্থক।