নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখিয়ের বিদায়

প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ

আর মাত্র পঁচিশটা দিনের জন্য শতবর্ষ স্পর্শ করতে পারলেন না রণজিৎ গুহ। ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় অস্ট্রিয়ায় নিজের বাড়িতে তাঁর জীবনের অবসান ঘটল। রণজিৎ গুহের জন্ম হয়েছিল ১৯২৩ সালের ২৩ মে, বাংলাদেশের সে সময়কার বাখরগঞ্জ জেলার সিদ্ধকাটি গ্রামে। ‘নিম্নবর্গের অধ্যয়ন’ নামে যে ইতিহাসচর্চার তিনি জন্ম দেন, এই শাস্ত্রে তা এক নতুন ধারার সূচনা করে। সাম্প্রতিক ইতিহাসবিদ্যায় রণজিৎ গুহ একটি অমোচনীয় নাম।

রাজনীতি আর গবেষণার বিপরীত দুই পথে কেটেছে রণজিৎ গুহের জীবন। ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢোকার পর ইতিহাসের খ্যাতনামা অধ্যাপক সুশোভন সরকারের সংস্পর্শে আসেন তিনি। যোগ দেন কমিউনিস্ট ছাত্রসংগঠনে। ছাত্র অবস্থাতেই হয়ে ওঠেন পার্টির সক্রিয় কর্মী। পার্টির সদস্য হিসেবে ১৯৪৭ সাল থেকে পরের সাতটি বছর যোগ দেন প্যারিসের বিশ্ব গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের সম্পাদকমণ্ডলীতে।

১৯৫৩ সালে ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে শিল্প, কৃষি ও রাজস্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস নিয়ে নিবিষ্ট পিএইচডি গবেষণা আর পার্টির আন্দোলন–সংগ্রামের দায়িত্ব পালন।

নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনায় রণজিৎ গুহ ঝুঁকে পড়েছিলেন মার্ক্সবাদের প্রেরণায়। কিন্তু ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় আগ্রাসন চালালে পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

১৯৫৯ সালে ভারত ছেড়ে রণজিৎ গুহ চলে যান যুক্তরাজ্যে। কাজ করেন ম্যানচেস্টার ও সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭০ সালে বছরখানেকের জন্য ভারতে এলে নকশাল আন্দোলন আর একদল তরুণ নকশালপন্থী ছাত্রের সংসর্গ তাঁকে চিরকালের জন্য পাল্টে দেয়। বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নেন কৃষকবিদ্রোহের ইতিহাস। ১৯৮৩ সালে বেরোনো ‘দ্য এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ তাঁর সেই গবেষণার ফল।

রণজিৎ গুহের মনে হলো, ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস লেখার সংকট শুধু উপনিবেশের পণ্ডিতদের মধ্যেই নয়, নিজেদের দেশের জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের মনের গভীরেও বাসা বেঁধে আছে। তাঁদের ইতিহাস নতুন আবরণে অভিজাতদেরই ইতিহাস। দৃশ্যমান আন্দোলনের বিপরীতে ভাষাহীনদের অদৃশ্য আবেগ আর চর্চার মধ্যে ইতিহাসের সত্য লুকিয়ে আছে।

এ থেকেই নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চার জন্য রণজিৎ গুহের লড়াইয়ের সূচনা। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি সাবঅলটার্ন স্টাডিজ নামের প্রভাবশালী সংকলনটি সম্পাদনা করতে শুরু করে দিয়েছেন। জড়ো করেছেন একদল তরুণ ইতিহাসবিদকে। ১৯৮৩ সালে প্রথম নিম্নবর্গ অধ্যয়ন সম্মেলনেরও আয়োজন করলেন। তাঁকে তত্ত্বগুরু মেনে দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে প্রমুখ ইতিহাসবিদ নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা করে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা মুখর করে তুললেন।

১৯৮০ সালে রণজিৎ গুহ যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছরগুলোতে সম্পাদনা করেন সাবঅলটার্ন স্টাডিজ সংকলনের ছয়টি খণ্ড। এরপর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্বের বিচিত্র কোণে কোণে বক্তৃতা দেন। ২০০৯ সালে ৪৫তম সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট দিয়ে সম্মানিত করে।

১৯৯৯ সালে বাইরের পৃথিবীর হাতছানি চিরদিনের জন্য গুটিয়ে নেন রণজিৎ গুহ। স্ত্রী মেখঠিল্ড গুহকে নিয়ে শেষ আবাস গড়েন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। এরপর লিখে গেছেন কেবলই বাংলায়। তাঁর শেষ শয্যায় স্ত্রীই ছিলেন পাশে।