বরিশালের শায়েস্তাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত কিশোর–কিশোরী ক্লাব। সম্প্রতি তোলা
ছবি: নাজনীন আখতার

পটকাজোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত কিশোর-কিশোরী ক্লাবের নতুন সদস্য তানজিনা (ছদ্মনাম)। ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালিন্দী ইউনিয়নের ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এই ছাত্রী ক্লাবে যুক্ত হলেও ১৫ মার্চ এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আড়াই মাসে একবারও গানের ক্লাস পায়নি। সে বলে, ‘স্যার আসেন না।’ আরও দুই শিশু ও তাদের অভিভাবকেরা জানান, সপ্তাহে দুই দিনের পরিবর্তে এক দিন (সোমবার) শুধু আবৃত্তি ক্লাস হচ্ছে। যেদিন ক্লাস হয় না, সেদিন বরাদ্দ নাশতাও বন্ধ থাকে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত গান, আবৃত্তি, কারাতের মতো সৃজনশীল এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করাসহ জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও মাদক প্রতিরোধ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রতিটি ক্লাবে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ২০ কিশোরী ও ১০ কিশোর—মোট ৩০ জনকে সদস্য করা হয়।

 ১০ মার্চ কেরানীগঞ্জের তিনটি ক্লাব এবং ২০ জানুয়ারি বরিশাল সদর উপজেলার একটি ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাবগুলোতে ক্লাস না হলে নাশতা বন্ধ থাকে। ছুটির দিনের বদলে নিজেদের মতো সময় ঠিক করে নেওয়া হয়। কারাতে প্রশিক্ষকেরা অনিয়মিত। ক্লাব সমন্বয়কারী হিসেবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের নারী সদস্যরা নিযুক্ত থাকলেও সম্মানী বন্ধ হওয়ায় তাঁরা আসেন না। তাঁদের দায়িত্ব ছিল, এলাকার কিশোর-কিশোরীদের উদ্বুদ্ধ করা ক্লাবে যুক্ত ও নাশতা বিতরণ করা। ক্লাবে তবলা থাকলেও তবলচি নেই। ক্লাবে আশপাশের বিদ্যালয়ের কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও যে বিদ্যালয়ে ক্লাব হয়েছে, শুধু সেই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরই এতে সদস্য করা হয়েছে।

ক্লাবসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আবৃত্তি ও গানের শিক্ষকেরা এক দিনে ৫০০ টাকা পান। ক্লাসে যাতায়াত, ক্লাস অনলাইনে আপলোড করতে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ব্যবহার, নাশতা কিনে বিতরণ ইত্যাদি দায়িত্ব শিক্ষকদের। পারিশ্রমিক যা পান, তার বড় অংশ এভাবে খরচ হয় বলে শিক্ষকেরা আগ্রহ বোধ করেন না। মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৯ হাজার ৭৬৬। আর ক্লাবের তুলনায় কারাতে প্রশিক্ষক কম, মাত্র ১৩০ জন। একজন কারাতে প্রশিক্ষক মাসে ১৫ হাজার টাকা পান।

‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প মেয়াদ ২০১৮ সালে শুরু, শেষ ২০২৩ সালে। ৫৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় ৬৪ জেলায় ৪ হাজার ৮৮৩টি ক্লাব করা হয়। শিক্ষক ও কিশোর-কিশোরী না পাওয়ায় কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন ও কুতুপালংয়ে ক্লাব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শিক্ষক আসেন না, নাশতা বন্ধ

১০ মার্চ বিকেলে পটকাজোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাবটি বন্ধ। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মারফত আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল বন্ধ থাকলে কিশোর-কিশোরীরা আসতে চায় না। তাই সোম ও বুধবার স্কুল শেষে বিকেল চারটায় ক্লাস হয়। গানের শিক্ষক না আসায় এক দিন ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষক নাশতা বিতরণ করেন। তাই শিক্ষক না এলে নাশতা বন্ধ থাকে।

শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ৫৫ নম্বর কালিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, ওই বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবেও আড়াই মাস ধরে দুই দিনের পরিবর্তে এক দিন সোমবার ক্লাস হচ্ছে। সেখানে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গানের ক্লাস করে ক্লাবের কিশোর-কিশোরীরা বিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাসে যোগ দেয়।

ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা বেগম বলেন, এক দিন ক্লাস হচ্ছে, তাই এক দিন নাশতা দেওয়া হচ্ছে। আবৃত্তির শিক্ষক অসুস্থ। নাশতায় কখনো কেক, কখনো বাটার বান, বিস্কুট দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) মো. লিয়াকত আলী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সপ্তাহে দুই দিনের হিসাবে এক মাসের নাশতার অর্থ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্লাস এক দিন হওয়ার কথা নয়। ক্লাস না হলে কিশোর-কিশোরীদের নাশতা না দেওয়া উদ্বেগজনক, অন্যায়।

এর আগে গত বছরের ক্লাবে নাশতার বরাদ্দ জুলাই থেকে অর্ধেক এবং সেপ্টেম্বর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর সদস্য উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমেছিল। যেমন সাতক্ষীরায় রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ক্লাবে ৩০ জন সদস্যের মধ্যে উপস্থিতি ৭ জনে নেমে এসেছিল। গত বছরের ১৯ অক্টোবর ‘ব্যয় কমাতে শিশুদের নাশতা বন্ধ’ শিরোনামে এই প্রতিবেদকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সমালোচনার মুখে ৪ নভেম্বর থেকে অর্ধেক এবং ১৮ নভেম্বর থেকে জনপ্রতি পুরো বরাদ্দ ৩০ টাকা করে নাশতা বহাল করে সরকার। ভ্যাটসহ বিভিন্ন খরচের পর নাশতা কেনার জন্য থাকে ২২ টাকা।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা বলেন, মাসের মাঝামাঝি সময়ে নাশতার বিল পাওয়া যায়। বিল না পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষকেরা নিজেদের খরচে নাশতা কিনে নিয়ে যান ক্লাসে। দুটি ক্লাবে এত দীর্ঘদিন গান ও আবৃত্তির শিক্ষক অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে জানা ছিল না। তথ্য গোপন করে তাঁরা নাশতার বিল তুলেছেন।

বিল তোলার কথা স্বীকার করে পটকাজোর ক্লাবের গানের শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র শুভ বলেন, ক্লাস গুছিয়ে নিতে সময় নিচ্ছেন। বাদ পড়া ক্লাস পরে করিয়ে, সদস্যদের বেশি করে নাশতা খাইয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। তাঁর মতে, সদস্যদের গানের চেয়ে নাশতায় আগ্রহ বেশি।

কাগজে-কলমে প্রতি ক্লাবে ৩০ জন করে সারা দেশে ক্লাবগুলোতে সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯০। প্রতি ক্লাবে ৩৫ জনের হিসাবে দিনে ১ হাজার ৫০ টাকার নাশতা বরাদ্দ হয়। সেই হিসাবে ক্লাবগুলোর জন্য এক দিনের নাশতায় বরাদ্দ হয় ৫১ লাখ ২৭ হাজার ১৫০ টাকা।

সারা দেশে ঠিক কত ক্লাবে এক দিনের বেশি ক্লাস হয় না, জানা যায়নি। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদন থেকে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।

১০টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব পরিদর্শনের পর গত বছরের ৩১ অক্টোবর আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪টি ক্লাবে দুই দিনের পরিবর্তে এক দিন ক্লাস হয়, দুটি ক্লাবে দুই দিনই ক্লাস হয়। বাকি ৪টি ক্লাবে কয় দিন ক্লাস হয়, সেটি স্পষ্ট করা হয়নি প্রতিবেদনে। আইএমইডির পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন) খলিল আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত বছরের ২০ ও ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার সদর ও মহেশখালী উপজেলায় ১০টি ক্লাব পরিদর্শন করে।

প্রকল্প কার্যক্রম অনুসারে, পুষ্টির চাহিদা বিবেচনায় নাশতায় সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে কেক, বাটার বান, মৌসুমি ফল, মিষ্টি, দই—যেকোনো একটা কিছু থাকার কথা।

তবলচি নেই, কারাতে প্রশিক্ষক আসেন না

গত ২০ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেল চারটায় বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নতুন ভর্তি সদস্যের সঙ্গে পুরোনোরাও রয়েছে। গানের শিক্ষক হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে কিশোর-কিশোরীরা।

তবলায় থেমে থেমে শুধু টোকা দিচ্ছে ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মোহনা আক্তার। সে জানায়, তবলা বাজাতে পারে না। তবলচি নেই, তাই গানের তাল রাখতে শিক্ষক তাদের এভাবে টোকা দিতে শিখিয়েছেন। সদস্য মোহনা, মন্দিরা হালদারসহ কয়েক কিশোর-কিশোরী জানায়, ক্লাবে গান-আবৃত্তি শেখা, ক্যারাম লুডু খেলা আর নিজেদের মতো এক ঘণ্টা সময় কাটানো তাঁদের জন্য বেশ আনন্দের।

ওই ক্লাবে কারাতে প্রশিক্ষক নেই। বরিশালের সদর উপজেলায় মোট ১০টি ক্লাব রয়েছে। কেরানীগঞ্জের তিনটি ক্লাবের কোনোটিতে কারাতে প্রশিক্ষক নিয়মিত নন।

কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের ২০ নম্বর কালুনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, ওই ক্লাবেও কারাতে প্রশিক্ষক নিয়মিত নন। ক্লাবের কারাতে প্রশিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম খান বলেন, তাঁর ওপর ১২টি ইউনিয়নের দায়িত্ব। তিনি নিয়মিত শেখান। কালুনগর ক্লাবে নতুন করে সদস্য নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য শেখাতে পারেননি। আর কালিগঞ্জের ক্লাবে তাঁর দেওয়া সময় অনুযায়ী সদস্যরা আসতে চায় না।

কালুনগরের সামনে কথা হয় বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের সঙ্গে। জায়গা না হওয়ায় ক্লাবে ভর্তির সুযোগ হয়নি বলে জানায় সে। অন্যগুলোর মতো সেখানেও ক্লাবের ৩০ সদস্যের সবাই ওই স্কুলের।

শাক্তা, কলাতিয়া, তারানগর ও হযরতপুর ইউনিয়নের ক্লাবের জেন্ডারভিত্তিক তথ্য প্রচারক মো. আল মামুন বলেন, প্রকল্পের নিয়ম মেনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশপাশের অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও সদস্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই স্কুলের ৯ জনকে রেখে বাকি ২১ জনকে অন্য স্কুল থেকে নেওয়ার তালিকা করা হচ্ছে।

এদিকে আইএমইডির প্রতিবেদনে ক্লাবে কারাতে প্রশিক্ষক ও নারী সদস্যের না আসা, হারমোনিয়াম-তবলা নষ্টের বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাতে প্রশিক্ষকেরা অনিয়মিত। কখনো কখনো কারাতে প্রশিক্ষক নিজে উপস্থিত না থেকে ছাত্রদের দিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালিয়েছেন। দু-তিনটি ক্লাব মিলে একজন কারাতে শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ক্লাবগুলোর দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় এবং যাতায়াত সুবিধা না থাকায় তাঁরা নিয়মিত ক্লাস নিতে পারেন না।

প্রশিক্ষকদের কার্যক্রম আরও নিবিড়ভাবে তদারকি করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ক্লাব সমন্বয়কারী হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের রাখা হয়েছে। তবে তাঁরা ক্লাবে কখনো আসেন না। শুধু স্বাক্ষর দিয়ে দুই হাজার টাকা বেতন তুলে নিয়ে যান। এখন সম্মানী বন্ধ থাকায় আর আসেন না। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প সংশোধন বা মেয়াদ বাড়ানোর সময় এই পদটি না রাখার সুপারিশ করা হয়।

তদারকির ঘাটতি রয়েছে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ রকম ভালো একটি উদ্যোগ তদারকির ত্রুটিতে যদি ভেস্তে যায়, তবে তা বাঞ্ছনীয় নয়। একজন শিক্ষকের ওপর দায়িত্ব রয়েছে ক্লাস করানো ও নাশতা বিতরণ করা।

সেই দায়িত্ব তিনি এড়িয়ে গেলে তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কেন প্রশিক্ষক, শিক্ষকেরা অনিয়মিত, তা স্থানীয় তদারকির মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা উচিত। নিয়মিত বেতন-ভাতা, নাশতা দুটোই জরুরি।