গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একঝাঁক চিত্রকরের হাত ধরে এ দেশের শিল্পকলায় যে অভূতপূর্ব বিকাশ সাধিত হয়েছিল, সেখানে একজন ভাস্করের আবির্ভাব ছিল তুমুল আশাজাগানিয়া। সেই ভাস্করের নাম নভেরা আহমেদ। তাঁর কাজের সঙ্গে এ অঞ্চলের শিল্পপ্রেমীদের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৫৮ সালে হামিদুর রাহমান ও নভেরা আহমেদের যৌথ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে।
যৌথ প্রদর্শনীটির তিন বছর পর ১৯৬০ সালের ৭-১৬ আগস্ট ১০ দিনব্যাপী ঢাকার সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরিতে নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন করে তৎকালীন পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতি। ‘অন্তর্দৃষ্টি’ শিরোনামে ওই প্রদর্শনীতে ৭৫টি ভাস্কর্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ২৬ বছরের তরুণী ভাস্কর এ দেশের শিল্পকলায় এক নতুন পালক যুক্ত করেন। শিল্প–গবেষকদের মতে, এ ভূখণ্ডে সেটিই ছিল প্রথম আধুনিক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন।
১৯৬০ সালের ৮ আগস্ট দৈনিক আজাদ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘ভাস্কর্য–শিল্প ক্ষেত্রে অগ্রণী হইবার জন্য তিনি (গভর্নর) পূর্ব পাকিস্তানের তরুণী শিল্পী নভেরা আহমেদকে আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছেন এবং আশা করিতেছেন যে প্রদেশের অন্যান্য শিল্পীগণও তাহার অনুসারী হইবেন।’
উদ্বোধনী ভাষণ শেষে গভর্নর এ দেশের ভাস্কর্যশিল্পের আলোকবর্তিকা বহনকারী নভেরার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে তাঁর শিল্প সৃষ্টির সহায়তাকল্পে ১০ হাজার টাকা সাহায্য ঘোষণা করেন বলেও দৈনিক আজাদ তাদের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।
কিন্তু ভাস্কর নভেরা এ দেশে আর থিতু হতে পারলেন না, বিশ্বের নানা শহর ঘুরে অবশেষে পাড়ি জমালেন ফ্রান্সে এবং ২০১৫ সালের ৬ মে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথম একক প্রদর্শনীর পর থেকেই তাঁর কোনো খবরাখবর ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছিল না, তবে ১৯৭০ সালে ব্যাংককে দ্বিতীয় এবং ১৯৭৩ সালে প্যারিসে তাঁর তৃতীয় একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর কথা জানা যায়। এর পর থেকে প্রায় চার দশক এ দেশের অগণিত শিল্পানুরাগীর কাছ থেকে নিজেকে তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন। সেই সময়কালে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় নানা মিথ, কবিতা, গল্প-উপন্যাস।
নভেরার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার অনেক বছর পর ১৯৯৫ সালে সাহিত্য প্রকাশ নিয়ে আসে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাস নভেরা। স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া নামটি আবার জাগ্রত হয় পাঠক-মানসপটে।
উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার এক দশক পর ২০১৫ সালে আবুল হাসনাত সম্পাদিত নভেরা আহমেদ প্রকাশিত হয় বেঙ্গল পাবলিকেশন থেকে। বইটি মূলত ভাস্কর নভেরাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত ১৭টি রচনার একটি সংকলন। সেই সংকলনে নভেরার শিল্পকর্ম নিয়ে লিখেছেন লালা রুখ সেলিম, নভেরার জীবনবৃত্তান্ত ও তাঁর কর্মজীবনের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন মেহবুব সেলিম, ইকতিয়ার চৌধুরীর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে নভেরার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, নভেরার কাজ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আয়োজিত ১৯৯৮ সালের প্রদর্শনী সম্পর্কে লিখেছেন রবিউল হুসাইন; রেজাউল করিম সুমনের লেখায় উঠে এসেছে ষাট ও সত্তরের দশকে নভেরার কর্মজীবন ও সৃষ্টি, আহমেদ সজীব লিখেছেন নভেরার জীবনবৃত্তান্ত, ময়নুল ইসলাম পল আলোচনা করেছেন নভেরার ভাস্কর্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, স্মৃতিচারণা করে নভেরাকে নিয়ে লিখেছেন শিল্পী রফিকুন নবী, নভেরা আহমেদের আধুনিক শিল্পকর্মের মূল্য ও তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন মইনুদ্দীন খালেদ ও ইমতিয়ার শামীম এবং নভেরাকে নিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি নাতিদীর্ঘ রচনা গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
নভেরা আহমেদকে নিয়ে তৃতীয় বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সাখাওয়াত টিপুর রচনায় নভেরার রূপ বইটি প্রকাশ করে আদর্শ প্রকাশনী। এ বই নভেরার শিল্প সমালোচনায় দর্শনের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলনে নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, একই সঙ্গে নভেরার শিল্পের সঙ্গে আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছেন লেখক।
পরের বছরই নভেরাকে নিয়ে এক চমকপ্রদ বই নিয়ে আসেন ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক ও লেখিকা আনা ইসলাম। নভেরার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল এই লেখিকার। নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নভেরার খোঁজ তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে। ২০২০ সালে নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে শিরোনামে আনা ইসলামের সেই বইটি নিয়ে আসে জার্নিম্যান বুকস এবং ২০২১ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে নভেরাকে নিয়ে সর্বশেষ প্রকাশিত বই শিকোয়া নাজনীনের রচনায় নভেরা: শিল্পের রহস্যমানবী। শিকোয়া এ বইয়ে অজানা, অবোধ্য ভাস্কর নভেরাকে চিত্রিত করেছেন তাঁর তথ্যবহুল লেখনীর মধ্য দিয়ে, একই সঙ্গে নভেরার জীবন ও শিল্পের ছায়া–আবছায়া নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোকপাত। প্রথমার এই বইটি ইতিমধ্যে পেয়েছে বিপুল পাঠকপ্রিয়তা।