কেউ ‘মৃত’, কেউবা ‘বিদেশে’, তাঁদের নামে বেতন তিতাসে

মৃত ব্যক্তি, বিদেশে থাকা, অবসরে যাওয়া তিতাসের কর্মীদের নামে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করেছেন, এমন ৩৭ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন সোহেল রানা। ২০১৩ সাল থেকে তিনি আর সেখানে চাকরি করছেন না। কিন্তু তাঁর নামে প্রায় আট বছর নিয়মিত বেতন–ভাতা হয়েছে। তাঁর ব্যাংক হিসাবে টাকাও গেছে। সেই বেতন কে তুলে নিয়েছে, তার খোঁজে নেমে দেখা গেছে, সোহেল রানার নাম ব্যবহার করে সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে কাজ করেছেন জাকারিয়া মাসুদ নামের এক ব্যক্তি। তবে তিনি বেতন পেয়েছেন ‘নগদে’।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এমন ৩৭ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাঁরা ৯০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ‘ঘুষ’ দিয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ‘নিরাপত্তা প্রহরী’ হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।

জাকারিয়া মাসুদ প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, তিনি সোহেল রানার নামে ডিউটি করেছেন, তবে বেতন পেয়েছেন অনেক কম। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়োগ পেয়েছিলাম তিতাস অফিসের একজনের মাধ্যমে। ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এ চাকরি পেয়েছি। আমি জানতাম না সোহেল রানার নামে আমাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। চাকরিতে যোগদানের দুই দিন পর রোস্টারে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখি আমার নাম নয়, সোহেল রানার নাম। পরে আমি ঠিকাদার কোম্পানি (মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি) ও তিতাসে অনেকবার গিয়েছি। আমি মাসুম স্যারের বাসায়, অফিসে (বর্তমানে তিতাসের কোম্পানি সচিব, তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার মাসুম) গিয়েছি। কিন্তু সবাই বলেছেন চুপ করে কাজ করতে। বলেছেন কোনো অসুবিধা হবে না। এভাবে গত আট বছর সবাই আমাকে সোহেল রানা নামেই চিনেছে।’

তিতাস, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশে এমন জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।
ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

একইভাবে আল আমিন নামের একজন আট বছর ধরে চাকরি করেছেন মৃত ইব্রাহিম খলিল ‘সেজে’। ইব্রাহিম খলিল অনেক আগেই মারা গেছেন। আল আমিন বলেন, ‘৯০ হাজার টাকা দিয়ে আমি ঢুকেছিলাম। জাহাঙ্গীর নামের একজনকে টাকা দিয়ে চাকরিটা পাই। অনেকবার বলেছি, এত টাকা দিয়ে ঢুকেছি, অন্যের নামে কাজ কেন করব? তবু তারা নাম পরিবর্তন করেনি।’

অন্তত ২০ জন নিরাপত্তা প্রহরী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সবাই তিতাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে ‘ঘুষ’ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। একজন বলেছেন, তিনি তিন লাখ টাকা দিয়েছেন, পরে শুনেছেন এই টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়েছে প্যান্থার সিকিউরিটি ও তিতাসের লোকজনের মধ্যে। নাম বদল করে চাকরি করা লোকেরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে যাঁরা মৃত, যাঁরা বিদেশে গেছেন কিংবা অবসরে, তাঁদের ‘নামে’ চাকরি হয়েছে। তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করা হয়নি।

নিয়ম অনুযায়ী, তিতাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কার্যালয়ে একজনকে নিরাপত্তা প্রহরী পদে চাকরি পেতে হলে জীবনবৃত্তান্ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যানের সনদ জমা দিতে হয়। নিরাপত্তা প্রহরী নেওয়ার আগে পুলিশি যাচাই (ভেরিফিকেশন) প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।

তিতাসের দুজন কর্মকর্তা বলেন, এত বড় অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে তিতাসের কোম্পানি সচিব ও তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার নিজেই একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমানকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটিকে আর্থিক বা অসংগতির বিষয়টি বের করার বিষয়ে কার্যপরিধিতে কিছু উল্লেখ ছিল না।

ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, এ তদন্ত প্রতিবেদন অনেক দিন ধামাচাপা দেওয়া হয়। অন্যদিকে যাঁরা অন্য নামে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেছেন, তাঁদের কিছুদিন বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তিতাসে জনবল সরবরাহ করেছিল মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসেস। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে কালোতালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তবে প্যান্থার সিকিউরিটি দাবি করেছে, তারা যা করেছে, তা তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েই।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, আমাকেও বিষয়টি জানানো হয়নি। জ্বালানি বিভাগকে আমি অনেকবার বলেছি নীতি মেনে পরামর্শক নিয়োগ করে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার জন্য। তারা তা করে না, কথাও শোনে না। কেন এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সেটা আমি জানতে চাইব, কঠিন ব্যবস্থা নেব।’

তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে

তিতাস গ্যাস কোম্পানির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ৩৭ জন বা এর বেশি অননুমোদিত ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রমাণিত হয়েছে। কমিটি বলেছে, তিতাস গ্যাসের নিরাপত্তা বিভাগ যাচাই–বাছাই না করে প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসেসের দেওয়া বিল পরিশোধের জন্য নিয়োগ শাখায় পাঠিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ অনিয়ম চললেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তিতাস গ্যাস কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তা বিভাগ। কোম্পানির বিভিন্ন কার্যালয়ের কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিরাপত্তায় কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের তদারকির দায়িত্ব নিরাপত্তা বিভাগ পরিচালনা করে। নিরাপত্তা বিভাগের নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায়, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এ অনিয়ম সংঘটিত হচ্ছে। এ দীর্ঘ সময় নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ‘ভুয়া’ নিরাপত্তারক্ষীদের হাজিরা প্রত্যয়ন করে নিয়োগ শাখায় পাঠিয়েছেন। কোম্পানির এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা ঠিকভাবে কাজ করছেন কি না, তা যাচাই না করে হাজিরা শিট প্রস্তুত ও প্রত্যয়ন করা গুরুতর দায়িত্ব অবহেলার শামিল বলে কমিটি মনে করে। তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পুরো বিষয়টি অবহেলা করেছেন বলে কমিটি মন্তব্য করেছে।

কমিটি জানিয়েছে, মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি প্রতি মাসে কর্মরত জনবলের বিপরীতে যে বিল মানবসম্পদ বিভাগে দিয়েছে, তারা আসলে সেখানে কাজই করেনি। তারা চুক্তির বিভিন্ন ধারাও লঙ্ঘন করেছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের এমন কাজ কোম্পানির নিরাপত্তার জন্য হুমকি। চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া নিরাপত্তা প্রহরীর স্থলে অন্য নিরাপত্তাপ্রহরীকে নিয়োজিত করার বিষয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা বিভাগকে জানায়নি। জালিয়াতি করায় তদন্ত কমিটি প্যান্থারকে কালোতালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছে।

ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমি সত্য কথা লিখেছি। নিরাপত্তার দায়িত্বে অনেক আগে কিছু লোক নেওয়া হয়েছিল। এদের জায়গায় অন্য লোকেরা এসে আগের লোকদের নামে টাকা তুলে নিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পেয়েছি। জীবনবৃত্তান্ত ছাড়া ওদের কাছে কীভাবে বিল গেল, কেউ তা তদারক করেননি। এর ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বহিরাগত লোকদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া বিরাট অবহেলা।’

যাঁরা বেতন–ভাতায় স্বাক্ষর করেছেন

নিরাপত্তা প্রহরীদের হাজিরা শিটে স্বাক্ষর, প্রতিস্বাক্ষর ও প্রত্যয়ন করেছেন ১৪ জন কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন তিতাসের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাকিম, উপমহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) আমিরুল আসগর খান, উপমহাব্যবস্থাপক মাইন উদ্দিন, লুৎফুল হায়দার, আবুল সালেহ মাহমুদ, ব্যবস্থাপক শাহ মো. আল মাহমুদ, মিজানুর রহমান, আবদুস সালাম সরদার, ছায়েফ উদ্দীন, ব্যবস্থাপক (তৎকালীন উপব্যবস্থাপক) ফজলুল হক, উপব্যবস্থাপক মেসবাহুল আলম, সহকারী ব্যবস্থাপক শামসুল হক (অবসরপ্রাপ্ত), সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল ও সহকারী কর্মকর্তা কারিমুল হক। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার। জনবল প্রতিস্থাপন, নিরাপত্তা প্রহরীর নামে নিয়োজিত অপর কর্মীকে বেতন-ভাতা প্রদান, নিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রত্যয়নের বিষয়টি যাচাই–বাছাই করার দায়িত্বও তাঁর ছিল। জানতে চাইলে লুৎফুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আগে জানতাম না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্যান্থার যে লোক বদল করেছে, তা আমাদের বলেনি।’

তবে প্যান্থার সিকিউরিটি বলছে, তিতাসের অনুমতি ছাড়া কোনো লোককে এর নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক কামরুজ্জামান দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাসে আমরা আমাদের লোক কখনোই নিয়োগ দিতে পারি না। তিতাসের কর্মকর্তারা যাঁদের নাম দেন, আমরা তাঁদের তাদেরই নিয়োগ দিয়েছি। তাঁদের মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, ইউনিয়নের তদবিরেই লোক নিয়োগ দিয়েছি। তাঁরা আমাদের তালিকা দিয়েছিলেন, আমরা ব্যবসায়িক খাতিরে ওঁদের নিয়োগ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে তো আর যুদ্ধ করতে পারি না। আমরা যা করেছি, তাদের জানিয়েই করেছি।’ তাঁদের ঠিকাদারি কোম্পানিটি আর সক্রিয় নেই বলে তাঁর দাবি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাস, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশে এমন জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আপাদমস্তক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তিতাস। পুরো বিষয়টি দুদককে তদন্তের আহ্বান জানাই।’