অলস পড়ে আছে ১১৭ কোটি টাকার ইনকিউবেটর

১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত। এক বছর আগে উদ্বোধন। এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।

দেশের প্রথম ক্যাম্পাসভিত্তিক শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর। গত বছর উদ্বোধন করা হলেও অনেকটা অব্যবহৃতই পড়ে আছে সুরম্য ভবন, কম্পিউটার, ডরমিটরি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: সৌরভ দাশ

১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল দেশের প্রথম ক্যাম্পাসভিত্তিক শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর। গত বছরের জুলাইয়ে এটি উদ্বোধন করা হয়। এক বছর পার হলেও ইনকিউবেটরটি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। অনেকটা ‘অব্যবহৃত’ পড়ে আছে সুরম্য ভবন, কম্পিউটার ও ডরমিটরি।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) এটি অবস্থিত। ৪ দশমিক ৭ একর জায়গার ওপর দেশের প্রথম ক্যাম্পাসভিত্তিক আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরটি তৈরি করা হয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক তৈরি করা, শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করাসহ নানা লক্ষ্য নিয়ে এটি তৈরি করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় গত বছরের জুনে।

নথিপত্র অনুযায়ী, ইনকিউবেটরে অন্তত ১২টি প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর ৯টি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ডিলিজিট, সিমস ইন্টারঅ্যাকটিভ ও মিস্ত্রি বাজার নামের তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এলজি বাটারফ্লাই, চালডাল, রকওন আইটি গ্লোবাল, এয়ারবি, ইয়র্ক, ক্লিগ টেক জায়গা বরাদ্দ নিতে চায়।

এটি চুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেটি হয়নি। এ কারণে এখন জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ মশিউল হক, পরিচালক, শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর

ইনকিউবেশন ভবনে ২৭টি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান বসতে পারবে। বর্তমানে ১২টি স্টার্ট-আপ জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। সব কটি প্রতিষ্ঠানই স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইনকিউবেশন ভবনের প্রতি বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ নিতে খরচ হচ্ছে ১০ টাকা। ইতিমধ্যে ৫৫ হাজার বর্গফুটের মধ্যে ২৬ হাজার বর্গফুট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠান ডিলিজিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসাইন বলেন, তাঁরা সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার তৈরির কাজ করেন। স্বল্প পরিসরে তাঁরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শহর থেকে ক্যাম্পাস কিছুটা দূরে হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। চুয়েট বা হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ যাতায়াতের ব্যবস্থা করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য সুবিধা হতো।

সমন্বয়ের অভাব

সমন্বয়ের অভাবে জোড়াতালি দিয়ে ইনকিউবেটরটি চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের পরিচালক মোহাম্মদ মশিউল হক। তিনি বলেন, ইনকিউবেটর সেন্টারটি বর্তমানে পরিচালনা করছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এটি চুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। এ কারণে এখন জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। এটি কোন প্রক্রিয়ায় চলবে, বাজেট কীভাবে আসবে, কীভাবে ব্যয় হবে—তার মডেল ঠিক হয়নি। পুরোপুরি সুফল পেতে অন্তত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

চুয়েটের উপাচার্য মোহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও চুয়েটের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

চুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তি খাতের বড় কোনো প্রতিষ্ঠানকে আনা গেলে শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারতেন। হাতে–কলমে কাজ শিখতে পারতেন। কিন্তু এসব কিছুই হচ্ছে না। বেশির ভাগ সময় ইনকিউবেটরের দরজা বন্ধ থাকে।

সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইনকিউবেটরে জায়গা বরাদ্দ দিতে এক বছরে মাত্র দুবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে তেমন ওয়াকিবহাল নন।

ইনকিউবেটরটি পুরোদমে চালু না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন হাইটেক পার্কের সহকারী প্রকৌশলী ও ইনকিউবেটরের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা ওবায়েত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ার কারণে অনেকে ইনকিউবেটরে যেতে চাইছেন না। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা পোষণ করেছে। শিগগির পুরোদমে কাজ শুরু করবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর চুয়েট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে না দেওয়ার বিষয়টি আপাতত তাঁর জানা নেই।

যা আছে ইনকিউবেটরে

১০ তলার ইনকিউবেশন ভবনটি ডিম্বাকৃতির। সুরম্য এ ভবনের প্রতি ফ্লোর পাঁচ হাজার বর্গফুট করে।

ভবনের মোট আয়তন ৫০ হাজার বর্গফুট। ইনকিউবেশন ভবনের পাশেই শেখ জামাল ও রোজী জামালের নামে নারী ও পুরুষদের জন্য রয়েছে পৃথক দুটি চারতলাবিশিষ্ট ডরমিটরি। প্রতি ডরমিটরিতে ৪০টি কক্ষ আছে। এ দুটি ভবনের মোট আয়তন ৪০ হাজার বর্গফুট। আরও আছে ছয়তলা মাল্টিপারপাস প্রশিক্ষণ ভবন, যার প্রতি ফ্লোর ৬ হাজার বর্গফুট করে মোট আয়তন ৩৬ হাজার বর্গফুট।

ইনকিউবেশন ভবনের ভেতর রয়েছে স্টার্টআপ জোন, আইডিয়া বা ইনোভেশন জোন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিক কলাবোরেশন জোন, ব্রেনস্টর্মিং জোন, ই-লাইব্রেরি, ডেটা সেন্টার, রিসার্চ ল্যাব, বঙ্গবন্ধু কর্নার, প্রদর্শনী সেন্টার, ভিডিও কনফারেন্সিং কক্ষ ও সভাকক্ষ এবং আটটি কম্পিউটার ল্যাব।

ইনকিউবেটরে কর্মরত দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ হচ্ছে মাসে ২ লাখ টাকা, ইন্টারনেট বিল ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া গ্যাস বিল গড়ে ১০ হাজার টাকা ও কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ প্রায় এক লাখ টাকা।

আসবাবে জমেছে ধুলা

জুলাই ও আগস্ট—এ দুই মাসে ১০ বার এ ইনকিউবেটরে যান প্রথম আলো দুই প্রতিবেদক। প্রতিবারই ইনকিউবেশন ভবনের দরজা বন্ধ ছিল। ভেতরে ছিল ফাঁকা। সর্বশেষ ২ আগস্ট গিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ে।

এর আগে ১৬ জুলাই অফিস সহকারীর মাধ্যমে ইনকিউবেশন ভবনের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, প্রতি তলায় চেয়ার, সোফা ও টেবিল বসানো। ব্যবহার না হওয়ায় এসব আসবাবে ধুলো জমে গেছে।

ইনকিউবেটরে কর্মরত দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ হচ্ছে মাসে ২ লাখ টাকা, ইন্টারনেট বিল ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া গ্যাস বিল গড়ে ১০ হাজার টাকা ও কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ প্রায় এক লাখ টাকা। পরিচালক মশিউল হক জানান, ছয়জন কর্মকর্তাকে বেতন দিচ্ছে চুয়েট।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিলসহ অন্যান্য খরচ বহন করছে হাইটেক পার্ক। নথি অনুযায়ী, গত এক বছরে ক্যারিয়ার ফেস্ট, গণিত অলিম্পিয়াড, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনারের মতো ১০টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ইনকিউবেটর সেন্টারে।

এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ের অভাবে নষ্ট হচ্ছে, যা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন চুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও ইনকিউবেটরের প্রথম প্রকল্প কর্মসূচি পরিচালক মীর মুহাম্মদ সাক্বী কাওসার। তিনি বলেন, সমন্বয় ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এটি কাজে আসছে না।

ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা এবং বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে সহযোগিতা করা। তাই উদ্যোক্তাদের জায়গা বরাদ্দ ও কার্যক্রমে সহযোগিতা করার মাধ্যমে এটি পুরোদমে চালু করা উচিত।