ডেঙ্গুতে ৬৭ শিশুর মৃত্যু

দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে। এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু।

রাইদাহ গালিবার বয়স ছিল ১১ বছর। সে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। এই শিশুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।

রাইদাহ গালিবার মা কানিজ কুলসুম ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করেছেন যে তাঁর মেয়ের চিকিৎসায় অবহেলা হয়েছে। তিনি তদন্ত দাবি করেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে। ওই বছর ২৮১ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাব বলছে, এর মধ্যে ৬৭ জন শিশু, তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে; অর্থাৎ মৃত ব্যক্তিদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু।

রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাবে, গত বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের ২৪ শতাংশও ছিল শিশু। গত বছর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৯৭২।

২০০০ সালে দেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। তার পর থেকে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আসেনি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় কিছুটা হলেও ডেঙ্গুভীতি ছড়িয়েছিল। নতুন বছরেও তা অব্যাহত আছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এবার পরিস্থিতি একটু জটিল ছিল। এর কারণ দুটি। ডেঙ্গুর ধরন আছে চারটি (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪)। এ বছর একই সঙ্গে তিনটি ধরন সক্রিয় ছিল। অতীতে এমন দেখা যায়নি। আক্রান্ত রোগীদের হঠাৎই পরিস্থিতি খারাপ হতে দেখা গেছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মত দিয়েছেন।

দ্বিতীয় কারণটি রোগ সম্পর্কে বুঝে উঠতে না পারা। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মৌসুমি সর্দি-জ্বরে, আবার কেউ কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরও অনেকের কাছে তা গুরুত্ব পায়নি। ঠিক সময়ে পরীক্ষা করানো হয়নি। পরীক্ষা করানোর পর যখন রোগ শনাক্ত হয়েছে, তখন অনেক রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়েছে। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে; অর্থাৎ এসব রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়েছে পরিস্থিতি বেশ খারাপ হওয়ার পর।

এবার ডেঙ্গুতে যে ৬৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল)। প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক ও উপপরিচালক প্রবীর কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রম’ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে; অর্থাৎ একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হওয়ার পর শিশুদের হাসপাতালে আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে আনার আগে এসব শিশুর হয় আগে ঠিক চিকিৎসা হয়নি, অথবা কোনো চিকিৎসাই হয়নি।

কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া বা গোদরোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার যে সফলতা দেখিয়েছে, তা দেখাতে পারছে না ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা কর্মকৌশল নেই। অনেকে মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয়ের ওপর না থাকায় পরিস্থিতি এমন হয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশা জরিপ করে। আর ডেঙ্গু দেখা দিলে সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটায়। প্রতিবছর একই ঘটনা ঘটে। এভাবেই বছরের পর বছর যাচ্ছে। ২০০৫ বা ২০১০ সালে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ৫ বা ১০ বছরমেয়াদি সমন্বিত কোনো কর্মসূচি শুরু করলে এত দিনে সক্ষমতা হতো, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসত।