আজও হৃদয়ে সেই সহপাঠীরা
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০।
দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায় : [email protected]
বাবার হাত ধরে ঢাকায় আসছি। মা বাবাকে বলেছিলেন, আর না পড়ালে হয় না! বাবা বললেন, ওকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নিয়ে যাব। ভর্তি হতে পারলে পড়বে, না হয় ফেরত আসবে।
সেই সুদূর দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর শহর থেকে বাবার হাত ধরে পূরবী লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করি। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের সেই রাতে (১২ নভেম্বর) আমি লঞ্চে। আমি অবশ্য কিছু বুঝতে পারিনি। ভোলায় ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানির খবর জেনেছিলাম দুই দিন পর পত্রিকা পড়ে।
সকালে পৌঁছে বড় ভাইয়ের আস্তানায় উঠি। ফ্রেশ হয়ে বাবার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি। প্রথম দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কৌতূহলী মন আবার ভয়ে সন্ত্রস্ত। বাবাকে সঙ্গে এলাম কলাভবন। আমি চলে এলাম কলাভবনের তিনতলায় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। প্রথমেই পরিচয় হয় গফুর ভাইয়ের সঙ্গে। বিভাগের সহকারী গফুর ভাই সব নিয়মকানুন বলে দিলেন।
ভর্তির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা আর্টস ফ্যাকাল্টির বারান্দায় এক হয়েছি। ভাইভা বোর্ডে প্রত্যেককে ২০ থেকে ৪৫ মিনিট রাখা হয়। ভয় আর আতঙ্কে হাত-পা শীতল; কাঁপছে শরীর। মুখ শুকিয়ে তেজপাতা। ভেতরে ঝড়-তুফান।
গফুর ভাই নাম ধরে ডাকলেন। ভাইভা বোর্ডে যাওয়ার ডাক এল আমার। তখনো কাঁপছি আমি। ভেতরে পা রাখতেই একঝলকের মতো দেখলাম, লম্বা চেহারার সুদর্শন কোট, প্যান্ট, টাইয়ে আবৃত এক ভদ্রলোক পাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন। বোর্ডে উপবিষ্টদের মাঝের চেয়ারটি শূন্য। আমার ভেতরে জমাটবাঁধা ভয়টা কিঞ্চিত নড়ে উঠল। একনজর দেখা সে চেহারা আজও আমার চোখে ভাসে। শূন্য চেয়ারটির পাশের চেয়ারে উপবিষ্ট মাখনের মতো ফরসা সুন্দর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মেয়ে, তুমি মুখে পড়ছ কী?’ ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার দোয়া পড়ছি।
ডান দিকে বসা স্যার জিজ্ঞেস করলেন তুমি কোন কলেজ থেকে এসেছ? বললাম, পিরোজপুর কলেজ থেকে। তাঁর পাশের স্যার বলে উঠলেন, ‘ও কলেজ থেকে তুমি পাস করলে কীভাবে? ও কলেজে তো পরীক্ষার হলে ঘাড় ফেরাতে দেয় না। ওটা তো দরবেশ আলী খানের কলেজ।’
প্রাণে যেন কিছুটা পানি পেলাম। বললাম, তিনি আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার। ফরসা সুন্দর স্যার বলে উঠলেন, ‘এই মেয়ে, তুমি রোকেয়া হল চেনো?’
আচমকা এ প্রশ্নে আমি নার্ভাস হয়ে গেলাম। আগের দিন বিকেলে বাবার সঙ্গে রোকেয়া হল দেখেছিলাম। কিন্তু ভয়ে মুখ থেকে ‘না’ শব্দটি বেরিয়ে এল। তিনি আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘ওই যে লাল ইটের দেয়ালে ঘেরা, ওটাই রোকেয়া হল।’
ঘন ঘন দম নিতে নিতে আগের দিনের দেখা রোকেয়া হলকে যেন নতুনভাবে দেখছি। স্যার বললেন, ‘তোমার কাগজপত্র ওখানে চলে যাবে। তুমি ওখানে খোঁজ নেবে।’
আমার শরীরের ওপর থেকে কত ওজনের ভয়ের পাথরটা সরে গেল, তা কেবলই আমি অনুভব করলাম। বের হয়ে আসতেই জানলাম, আমি ভাইভা বোর্ডে ঢুকতেই যিনি বের হয়ে গেলেন, তিনিই ডিপার্টমেন্টের প্রধান এ বি এম হাবিবুল্লাহ স্যার। কিন্তু তিনি কেন বের হয়ে গিয়েছিলেন, আজও জানি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ক্লাস শুরু হয়েছিল। ’৭১ সালের ১ মার্চ উত্তাল পূর্ব পাকিস্তান। বাড়ি ফিরে গেলাম।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বাহাত্তরের শুরুতে আমরা ক্লাসে ফিরে গেলাম। ইমাম উদ্দীন স্যার, রেজা–ই–করীম স্যার, মোজাম্মেল হক স্যার, ড. আলিম স্যার, তাজুল ইসলাম হাশমী স্যার, আশরাফ উদ্দীন স্যার, মমতাজুর রহমান তরফদার স্যার, সিরাজুল ইসলাম স্যারের ক্লাস লেকচার শুনতাম, যা আজও কানে বাজে, চোখে ভাসে।
তেমনি চোখে ভাসে স্মৃতিতে মোড়ানো সোনারগাঁয়ে বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের প্রথম বনভোজন। খোলা মাঠে গোল করে প্লেট নিয়ে বসা। হঠাৎ চিলের মতো ছোঁ মেরে আমার প্লেটের মুরগির রোস্টটা একজন নিয়ে গেলেন। সবার মুখে রোমান্টিক হাসি। দৃশ্যটি চোখে আটকায় অনেকের মধ্যে আশরাফ স্যারেরও। মুহূর্তে আশরাফ স্যারের চোখের নির্দেশনায় আমার প্লেটে চলে এল আরেকটি মুরগির রান।
কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই সহপাঠীরা? হোসনে আরা, নজরুল, দেওয়ান, মান্নান ভাই। অনেক নাম এখন আর মনে করতে পারি না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলাম ১৯৭৪ সালে। সরকারি চাকরি করলাম। সচিবালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিলাম ২০০৭ সালে। কিন্তু আমি অবসর নিইনি। যোগ দিলাম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এরপর ২০১২ সালে একটি মাসিক পত্রিকায় নিউজ এডিটর হিসেবে কাজ করার সুযোগ এল। মাসিক পত্রিকা দৈনিক হলো। এই ৭৫ বছর বয়সেও সেখানে কাজ করছি। আমার পদের নাম অফিস ম্যানেজার।
দুই বছর আগে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অ্যালামনাই অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করে খুব কষ্টের সঙ্গে বলেছিলাম, কেন সহপাঠীরা কেউ নেই আজ এই টিএসসিতে। আমার আকুতি সেদিন নৈঃশব্দ্যকেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। উপস্থাপক সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরাই আপনার ক্লাসমেট, বন্ধু, ব্যাচমেট। আমরা সবাই এক।’
তারপরও মনে হয়—সহপাঠী এমন এক সঙ্গ, যার টান বন্ধুত্বেরও ওপরে। তাই তারা না থাকলেও স্মৃতি থেকে মুছে যায় না।
কামারুন-নাহার মুকুল, রূপনগর আবাসিক এলাকা, মিরপুর, ঢাকা