নারীর লেন্সে সমাজটাকে দেখতে চাই

২০০৬ থেকে অভিনয় করছি। প্রচুর নাটকে কাজ করেছি। তারপর তো চলচ্চিত্রে এলাম। নাটক করতে করতে নাটকের অবস্থাটা বুঝেছি। তারপর যখন সিনেমা করতে শুরু করলাম, সিনেমার পরিস্থিতিটাও আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। এত বছরের পেশাজীবনে যে উপলব্ধিটা হয়েছে, সেটা হলো বাংলাদেশে নারীপ্রধান গল্পে কাজ হয় খুবই কম। এই কম হওয়ার পেছনে ইন্ডাস্ট্রির কিছু গাফিলতি আছে। এখানে যাঁরা টাকা লগ্নি করেন, সেই মানুষগুলোর মনমানসিকতারও কিছু সমস্যা আছে।

দর্শক চান না, প্রযোজকও বানান না

সুপারস্টারের ওপর লগ্নি করলে টাকা ফেরত আসে। তাই পুরুষপ্রধান চরিত্রের সিনেমার ওপর প্রযোজকেরা বেশি টাকা লগ্নি করেন। দায়বদ্ধতার বিষয়টা তাঁরা মাথায় রাখেন না। তাঁরা কিন্তু এটা মনে করেন না যে তাঁদেরও সমাজের জন্য কিছু করার আছে। আমি এখানে প্রযোজকদের বেশি করে সামনে আনতে চাই। কারণ আমি মনে করি, বাংলাদেশে প্রচুর মেধাবী পরিচালক আছেন, প্রচুর অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, যাঁরা ভালো কাজ করার জন্য, একটু ভিন্ন কিছু করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু প্রযোজক যাঁরা আছেন, তাঁরা টাকাটা লগ্নি করার জন্য প্রস্তুত নন। এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসাটা খুব জরুরি।

দর্শকেরও দায় আছে। নারীপ্রধান গল্পের সিনেমা দর্শক হলে গিয়ে দেখতে চান না। যে গল্পগুলো হচ্ছে, সেখানে কী ধরনের নারী চরিত্র আমরা দেখি? সেই নারী চরিত্রগুলোকেই দেখি, নারীদের যে রকম করে দেখতে চায় সমাজ। সমাজের ওই তথাকথিত নিয়মের মধ্যে পড়ে না, এ রকম নারীকে পর্দায় আমরা কিন্তু গ্রহণ করি না। রেহানা মরিয়ম নূর নিয়ে আমরা কান চলচ্চিত্র উৎসব ঘুরে এসেছি, এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি, দর্শক কিন্তু এ রকম একটা নারী চরিত্রকে গ্রহণ করেননি। কিন্তু আপনি দেখবেন, একটা পুরুষ চরিত্র যখন সহিংসতা করে বা রাগী একটা চরিত্র করে, সেটা কিন্তু খুব সহজে গ্রহণ করা হয়।

সমাজে আমরা যেটা করি, সিনেমা তা-ই প্রতিফলিত করে। আসলে নারীপ্রধান গল্প বা একটু ভিন্নধর্মী কাজ, যেখানে নারী চরিত্রকে তথাকথিত নারীর মতো দেখানো হবে না, এ রকম চরিত্র খুব একটা সামনে আসে না। কিন্তু এ রকম অজস্র গল্প আছে, বাঁধ ভাঙার গল্প, যেগুলো মানুষ পর্যন্ত পৌঁছানো উচিত।

তারপরও নারীপ্রধান কিছু গল্প এখন হচ্ছে। যেমন রেহানা মরিয়ম নূর, প্রিয় মালতী, বাড়ির নাম শাহানা। এই সিনেমাগুলোর প্রতিটির কেন্দ্রেই কিন্তু খুব শক্তিশালী নারী। আমি যখন কাজ শুরু করেছিলাম, এ ধরনের সিনেমা তখন খুব একটা দেখিনি। সাহস করে পরিচালকেরা এ ধরনের সিনেমা করার জন্য এগিয়ে আসতেন না।

কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য

একজন পুরুষ শিল্পী অভিনয় করে যে টাকা পান, গুটিকয় নারী তাঁর কাছাকাছি পারিশ্রমিক পান। হাতে গোনা চার-পাঁচজন এ রকম আছেন। সিনেমাতে এই তফাত ভীষণভাবে আছে। নাটকে কোনো কোনো নারী অভিনয়শিল্পী আছেন, যাঁরা সমান সমান পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা ঘটে না।

কর্মক্ষেত্রটাও নারীর জন্য খুব প্রতিকূল। এমনিতেই মেয়েরা যখন বাসা থেকে বের হন, তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রতিকূল জীবন। ইন্ডাস্ট্রিতেও যে খুব নিরাপদ একটা পরিবেশে কাজ করি, এ রকম নয়। নির্যাতিত হওয়ার অনেক ঘটনাও এখানে আছে। অনেক এক্সপ্লয়েট হওয়ার ঘটনা আছে। ম্যানিপুলেট হওয়ার ঘটনা আছে। তা ছাড়া রাত হয়ে গেলে বাসাতেও ঝামেলা হয়। অনেক মেয়েকে দেখবেন, যাঁরা পোশাকে কাজ করেন, রূপসজ্জায় কাজ করেন, শিল্পনির্দেশনার কাজ করেন; তাঁদের কিন্তু বাসা থেকে ঝামেলা হয় শুধু রাত হয়ে যায় বলে। আমাদের শুটিংগুলো দেখা যায় রাত করে হচ্ছে, ওঁদের কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এভাবে তাঁদের কাজের ক্ষেত্রটা অনেক ছোট হয়ে যায়। হয়তো তাঁর প্রতিভা আছে, কিন্তু কাজটা তিনি চালিয়ে যেতে পারেন না। পরিবার ওভাবে সহায়তা করে না।

নারীপ্রধান গল্পের সিনেমা দর্শক হলে গিয়ে দেখতে চান না, তারপরও নারীপ্রধান কিছু গল্প এখন হচ্ছে
ছবি: সাবার পোস্টার

আবার একজন অভিনেত্রী যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হন বা যেভাবে তাঁর কোনো একটা নিউজকে রগরগে করে হাইলাইট করা হয়, ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। সেটাও কিন্তু কাজের ক্ষেত্রকে অনেক ছোট করে দেয়। আপনি হয়তো বলবেন, আপনাকেও তো অনেক ট্রল করে, আপনার তো কিছু হচ্ছে না। আমার কিছু হচ্ছে না কারণ, অভিজ্ঞতা। ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি কিন্তু প্রতিরোধী হয়ে গেছি। আমার কাছে এগুলোকে এখন আর কিছু মনে হয় না। কিন্তু আমার বয়স যদি এখন ২০-২১ বছর হতো আর এইভাবে আমাকে ট্রল করা হতো, আমার নিউজগুলোকে যদি এ রকম রসালো করা হতো, আমার পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হতো।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বয়স। বয়স হয়ে যাওয়ার পরও পুরুষেরা নায়ক হচ্ছেন, তাঁদের ওপর ভিত্তি করে গল্প হচ্ছে। তাঁদের কাজের ক্ষেত্রটা ছোট হয় না। কিন্তু মেয়েদের ৪০ হলেই কাজের ক্ষেত্রটা খুব ছোট হয়ে যায়। জয়া আহসানকে একটা বড় ব্যতিক্রম বলব। এই ট্রেন্ড তিনি ভাঙতে পেরেছেন। পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে জায়গাটা তিনি তৈরি করেছেন। কিন্তু সেই পথ এত সহজ নয়। আমি চেষ্টা করছি।

কারণ, প্রযোজক, পরিচালকেরা আসলে এই বয়সের নারী চরিত্র নিয়ে কাজ করেন না। হলিউডে আপনি দেখবেন, ৬০-৬৫ বছর বয়সেও অস্কার পাচ্ছেন। তাঁদের ওপর ভিত্তি করে গল্প হচ্ছে। ফলে যত বয়স হচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রটা তত বাড়ছে। সুযোগ বাড়ছে। চরিত্রের বৈচিত্র্য বাড়ছে। ভারতেও একই সমস্যা। তবে বলিউডেও নায়িকাদের নিয়ে কিছু কাজ এখন হচ্ছে। ইদানীং কাজল করছেন, কিন্তু সেটা খুবই কম। আর আমাদের এখানে নারী শিল্পীর সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হয়ে যায়। কারণ, এখানে চলচ্চিত্র বা নাটকে নারী আসলে অলংকার। খুব বেশি কাজ করার জায়গা তাঁদের থাকে না।

বাণিজ্যসফল সিনেমাগুলোতে দেখবেন, তিনি নায়িকা ঠিকই, তবে তাঁর চরিত্রটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ খুব একটা নেই। আরেকটা বিষয়ও আছে, সমাজও নারীকে খুব খারাপ হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। নারীবিদ্বেষী গল্পগুলো আমাদের এখানে খুব হিট। এইটার খুবই সফল উদাহরণ সুড়ঙ্গ আর পরান। আমার মনে হয়েছে, এই সিনেমা দুটি সুপারহিট হওয়ার পেছনে অনেক বড় একটা কারণ, সমাজে যে নারীবিদ্বেষটা আছে, সেটা পর্দায়ও দেখানো হয়েছে। এটা ছবিগুলোর সাফল্যকে একধরনের ত্বরান্বিত করেছে।

এই জিনিসগুলো থেকে আমাদের পরিচালক, আমাদের প্রযোজক, আমাদের শিল্পীদের সচেতনভাবে বের হয়ে আসতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে শিল্প ও শিল্পীর অনেক বড় ভূমিকা থাকে। সমাজের যে গতি, সমাজ যেদিকে যাচ্ছে বা সমাজ যা দেখতে চায়, শুধু সেই জিনিসগুলোকই কি আমরা দেখাব?

কী করা দরকার

এখানে অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারেন প্রযোজক। বাংলাদেশে ভালো প্রযোজকের বড় অভাব। ইন্ডাস্ট্রিতে শিক্ষিত ও প্রগতিশীল প্রযোজক লাগবে। যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য আসলেই কিছু করতে চান। এটাই প্রথম চাহিদা। প্রযোজক কি শুধু টাকা বানানোর জন্য এখানে আসছেন? কালোটাকা সাদা করার জন্য আসছেন? নাকি সমাজের জন্য কিছু করতে আসছেন? এগুলো তাঁর কাছে পরিষ্কার হতে হবে।

তারপর চাই পরিচালক, সেই সব পরিচালক, প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে সমাজটাকে যাঁরা দেখতে পারেন এবং মানুষকে সেটা দেখাতে চান। আমার সমাজ দেখতে চায় বা আমরা যেটাতে অভ্যস্ত, সেইটা দেখানোর অনেক লোক আছে। বাণিজ্যসফল পরিচালকদেরও গ্রুমিং দরকার, তাঁদেরকে বদলাতে হবে। ভারতের কথাই ধরুন। যশ রাজ ফিল্মস কিংবা করণ জোহরের ধর্ম প্রোডাকশনস কিন্তু ভীষণ রকম কমার্শিয়াল। কিন্তু আপনি দেখবেন, ওদের সিনেমাগুলোতে কিন্তু কোনো একটা সামাজিক বার্তা থাকে। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি বাণিজ্যসফল একটা সিনেমা বানাতে চান, তাহলে ওই পরিচালক বা ওই প্রযোজককে সমাজ নিয়ে চিন্তা করার সুযোগটা তৈরি করে দিতে হবে যে না, কিছু মেসেজ আমার সিনেমায় থাকবে এবং সেটা তাঁরা নিজে থেকেই করবেন। এ রকম না যে তাঁকে বাধ্য করা হবে, এই বোধ যাতে তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়।

আমার যেমন মনে হয়, এখানে নারী পরিচালকের প্রচণ্ড অভাব আছে। সমাজটাকে মেয়েদের চোখে দেখা, মেয়েদের লেন্স দিয়ে দেখাটা কিন্তু খুব জরুরি। নারী নির্মাতা যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এই ব্যবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠা। সমাজটাকেও তাঁরা প্রচলিত দৃষ্টিতেই দেখেন। প্রচলিত ব্যবস্থায় বেড়ে উঠলেও এসব প্রথা ও প্রতিবন্ধকতাকে ভাঙতে পারেন বা অন্যভাবে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পারেন, এ রকম নারী পরিচালক সমাজে খুব দরকার। আমি নারীর লেন্সে সমাজটাকে দেখতে চাই।

আবার অনেক পুরুষকেও চিনি, যাঁদের লেন্সেও সমাজটা অনেক আলাদা। আমাকে খুবই অবাক করেছে সাবা। যদিও এটা একটা পুরুষ পরিচালকের কাজ। পুরুষের চোখে একজন নারীকে দেখানো হয়েছে। সাবার চরিত্রটা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় লেগেছে। আমার রেহানা চরিত্রটাও একজন পুরুষের কলমেই লেখা। তবে রেহানা চরিত্রটায় প্রচণ্ডভাবে আমার ব্যক্তিগত ইনপুট ছিল। সেইটা আমার মনে হয় চরিত্রটার মধ্যে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। তাই নারী-পুরুষ সবাইকেই এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

অনুলিখিত