বরগুনায় ডেঙ্গু এত বৃদ্ধির পেছনে ‘ভিন্ন’ একটি কারণ, কী সেটা

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাছবি: রয়টার্স

শীতের মধ্যে বরগুনায় এডিস মশার লার্ভার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি চিন্তিত করেছিল গবেষকদের। শুধু বরগুনায় নয়, বরিশাল বিভাগের নানা স্থানে এডিসের উপস্থিতি পাওয়া যায় জরিপের সময়। জরিপ হয়েছিল চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে।

ওই জরিপে থাকা এক গবেষক বলেন, লার্ভা পাওয়ার স্থানগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। ডেঙ্গুর বিস্তারের ক্ষেত্রে সেটা একটা নতুন দিক উন্মোচন করেছে বলা যায়।

এডিস মশার অবস্থা বুঝতে দেশে সাধারণত তিন দফা জরিপ হয়। বর্ষার আগে, বর্ষার সময় এবং পরে। জরিপে এডিস মশার ঘনত্ব দেখে আগাম ধারণা পাওয়া যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটুকু হবে। এসব জরিপ হয় মূলত ঢাকার দুই সিটিসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে। অন্য স্থানেও হয় কখনো কখনো। এবার প্রাক্‌–বর্ষা জরিপ হয় সিটি করপোরেশনগুলোর পাশাপাশি দেশের অন্যত্রও। বিশেষ করে বরগুনাসহ বরিশাল বিভাগের কয়েকটি স্থানে জরিপ হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় এ জরিপ শেষ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)।

আরও পড়ুন
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

জরিপের ফল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ইতিমধ্যে তুলে ধরেছে আইইডিসিআর। তবে তা প্রচার করা হয়নি। তবে তা দ্রুতই প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন।

এ বছরের মধ্য জানুয়ারিতে হওয়া জরিপে দেখা যায়, দেশের ডেঙ্গুর প্রধান বিস্তারস্থল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার চেয়ে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। বিশেষ করে বরগুনা অঞ্চলে ঘনত্ব বিস্মিত করে জরিপকারীদের। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়।

বাংলাদেশে হওয়া সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ততার পরিমাণ ১২ পিপিটির ওপরে গেলে তাতে এডিসের বংশবিস্তার হতে পারে না। কিন্তু এটি ৮ পিপিটির নিচে গেলে সেখানে বংশবিস্তারের আশঙ্কা থাকে।

জরিপকারীদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকার দুই সিটির চেয়ে ব্রুটো ইনডেক্স বরগুনাতে বেশি ছিল কিছু এলাকায়। পুরো বরিশাল বিভাগেই বেশি ছিল। কিন্তু ঢাকায় আশ্চর্যজনকভাবে ব্রুটো ইনডেক্স ২০–এর নিচে ছিল অধিকাংশ স্থানে।

জরিপ হয় শীতের সময়। ওই সময় এডিসের উপস্থিতি এমনিতেই কম থাকে। আর রাজধানীর বাইরে তো আরও কম থাকার কথা ছিল। কিন্তু এরপরও এডিসের লার্ভার এই উপস্থিতি বরগুনাতে এত বেশি কেন?

ওই গবেষক বলছেন, ‘আমরা একটা বিষয় লক্ষ করলাম, বরগুনাতে সবচেয়ে বেশি এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে পানি ধরে রাখার বড় বড় মটকা বা প্লাস্টিকের তৈরি পাত্রগুলোতে। এসব পানি বৃষ্টির সময় ধরে রাখা হয়। সেই বর্ষা মৌসুমের পানি উন্মুক্ত করে রাখার কারণে সেখানে এডিসের বংশ বৃদ্ধি হয়েছে বলে ধারণা করছি আমরা। এটা শুধু বরগুনার গ্রামে নয়, পৌর এলাকার কিছু এলাকায়ও পাওয়া গেছে।’

পানির সংকটের সঙ্গে ডেঙ্গুর বিস্তারের এ সম্পর্ক একেবারে নতুন বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু বিস্তারের ক্ষেত্রে পানির সংকটের এ চিত্র আমাদের কাছে নতুন দিক তুলে ধরছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের নীতি ও পরিকল্পনায় এখন এটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে পারে।’

ডেঙ্গু বিস্তারের ক্ষেত্রে পানির সংকটের এ চিত্র আমাদের কাছে নতুন দিক তুলে ধরছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের নীতি ও পরিকল্পনায় এখন এটি ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারে।
মুশতাক হোসেন, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা

বরগুনা অঞ্চলে পানির সংকট অনেক বেশি। লবণাক্ততা এবং পানিতে আয়রনের আধিক্য থাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চল, বিশেষ করে বরগুনার গ্রামাঞ্চলের বড় অংশজুড়ে রয়েছে। পানি ধরে রাখা হয় বর্ষা মৌসুমে। এই পানি ব্যবহার করা হয় বছরের ভিন্ন সময়। শুধু বরগুনা নয়, দেশের উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চল অনেক পুরোনো।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশীয় প্রধান ডা. খায়রুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

আগে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তাতে যাতে মশা বা অন্য কোনো পোকার বংশবিস্তার না হয়, সে জন্য পানিতে মাগুর বা জিওল মাছ ধরে রাখার কৌশল ছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশীয় প্রধান ডা. খায়রুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে ধরে রাখা পানি মশা বা অন্য জীবাণুমুক্ত রাখতে জিওল মাছ বা মাগুর মাছ ছেড়ে রাখা হতো। এসব মাছ পানিতে হওয়া মশা বা অন্য পোকা খেয়ে ফেলত। এসব পদ্ধতি ছিল মানুষের প্রথাগত জ্ঞানের ফসল। কিন্তু কালক্রমে এসব জ্ঞান বা চর্চা হারিয়ে গেছে। পানির সংকট কাটেনি কিন্তু আমরা আমাদের ইতিবাচক চর্চাগুলো হারিয়ে ফেলেছি।’

দেশের সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্য এলাকাগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)। সংস্থার বরগুনা জেলা কার্যালয়ের হিসাব, উপকূলবর্তী এই জেলার ৪০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানি পায় না।

বাংলাদেশ গত প্রায় দুই দশকে পানি ও স্যানিটেশনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে ভালো করেছে। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায়। সে ক্ষেত্রে বরগুনা অনেকটাই পিছিয়ে।

বরগুনার ডিপিএইচের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, বরগুনাতে পানির সংকট আছে। সদর উপজেলার নলটোনা ও বালিয়াতলীতে সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থাই নেই। অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ এখানে সুপেয় পানি পায় না। এর জন্য এখানকার ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই দায়ী। লবণাক্ততার কারণেই এ সংকট। কোথাও কোথাও টিউবওয়েল বসালেও কিছুদিন পর সেখানে আর পানি ওঠে না। এটা হয় পানির স্তর নেমে যাওয়ার জন্য।

তবে শুধু বরগুনা নয়, গাজীপুর ও  নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরিচালিত লার্ভা জরিপেও ধরে রাখা সুপেয় পানিতেও এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। দুই নগরের পানির সংকট যথেষ্ট।

তবে শুধু বরগুনা নয়, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরিচালিত লার্ভা জরিপেও ধরে রাখা সুপেয় পানিতেও এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। দুই নগরের পানির সংকট যথেষ্ট। সে সময় গাজীপুরে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জে এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

সাধারণত সাগর তীরে মশার প্রকোপ কম হয়। সাগরের প্রবল হাওয়ায় এর বংশবৃদ্ধি কম হয় বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদেরা।

সাগরের লোনা পানিতে এডিসের বংশবৃদ্ধি হয় না বলেই জানান কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তবে তিনি বলেন, সরাসরি সাগরের পানি নয় উপকূলের এমন পানিতে এডিসের বংশবিস্তার হতে পারে। বাংলাদেশে হওয়া সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ততার পরিমাণ ১২ পিপিটির ওপরে গেলে তাতে এডিসের বংশবিস্তার হতে পারে না। কিন্তু এটি ৮ পিপিটির নিচে গেলে সেখানে বংশবিস্তারের আশঙ্কা থাকে।

বরগুনার পানির সংকট এবং সেখানে ধরে রাখা বৃষ্টির পানিতে লার্ভার উপস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করেন আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরিন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদন আপনাদের কাছে তুলে ধরব। তবে বরগুনায় ধরে রাখা পানিতে লার্ভার উপস্থিতির বিষয়টি লক্ষ করা গেছে, এতে ভুল নেই।’

উপকূলের জেলাগুলোতে এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার এবং এর সঙ্গে সুপেয় পানির সংকটের একটি সম্পর্ক উঠে এল। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রথাগত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং নতুন চর্চা দরকার বলে মনে করেন ডা. খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রথম প্রাধান্য হওয়া উচিত। উপকূলের মানুষের সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় সক্রিয় মনোযোগ দরকার।