বেশ কদিন থেকেই কাশি। কাশির সঙ্গে দুদিন রক্তও গেল। এরপর শুরু হলো শ্বাসকষ্ট। অনেক ছোটাছুটি করে জানা গেল—শ্বাসনালিতে টিউমার, ৯০ শতাংশ ব্লক। দেশে কিছু করার নেই। আমার জিশা আর জিহান এত অল্প বয়সেই ওদের মাকে হারাবে?

সে রাতেই সবাই ব্যাংকক আর সিঙ্গাপুরের হাসপাতালগুলোতে ই–মেইল দিতে শুরু করল। পরদিন ব্যাংকক থেকে উত্তর এল, লেজার দিয়ে টিউমার অপসারণ করা যেতে পারে। মনজুর সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ওর পাগলের মতো ছোটাছুটির কাছে সময় হার মানল। দুদিনের মধ্যে সব প্রস্তুত।

ফ্লাইটের আগের রাত সাড়ে ১০টায় বাড়ি গেলাম ব্যাগ গোছাতে। চার দিন আব্বার বাসায় আছি। পৌনে এগারোটায় শুরু হলো বেদম কাশি, সঙ্গে গলগল করে রক্ত। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমাদের এক আত্মীয়ের বন্ধু ডাক্তার। তিনি আমার মাথা ঝুলিয়ে চিত করে শুইয়ে দিয়ে ইনজেকশন দিতে বললেন।

শুলেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, অথচ উঠে বসলে আমাকে জোর করে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। খবর পেয়ে আব্বা আর সুজন চলে এল। সবাই কাঁদছে আর দোয়া পড়ছে।

রাত ১২টায় আমাকে একটা হাসপাতালে নেওয়া হলো। রাত একটায় একজন রক্ত দিল, আরেকজন প্রস্তুত হয়ে থাকল। শরীরে একদিকে রক্ত ঢুকছে, অন্যদিকে কাশির সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বেলা ১১টায় এয়ারপোর্টে রিপোর্টিং। বাসায় পৌঁছে দেখি, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবে ঘর লোকারণ্য। সবাই দেখতে এসেছেন। রক্তমাখা কাপড় বদলে জিশা আর জিহানকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সময় নেই। মনজুর আমাকে প্রায় টেনে বের করে নিয়ে এল। জানালা দিয়ে জিহানের বুকফাটা কান্নার শব্দ ভেসে এল, ‘আমি মামণির সাথে যাব।’

ব্যাংকক পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রায় আর কোনো অসুবিধা হলো না। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই আবার তীব্র শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরে কেমন যেন একটা অনুভূতি। অক্সিজেন টানতে পারছি না। সামান্য বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছি আমি।

ডাক্তার এসে বললেন, লেজার দিয়ে করা যাবে না বলে তাঁরা কণ্ঠনালি খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একটা কাগজে নানা ছবি এঁকে তিনি বললেন, ‘এই তোমার শ্বাসনালি, আর এই তোমার টিউমার। আমরা টিউমারসহ শ্বাসনালির একটা অংশ কেটে ফেলে দুটি কাটা প্রান্ত জোড়া দিয়ে দেব। এতে শ্বাসনালি ছোট হয়ে যাবে। দুই সপ্তাহের মতো মাথাটা তোমাকে বুকের কাছে হেলিয়ে রাখতে হবে।’

ডাক্তার বললেন, হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। সময়ও কম। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। তবে ওপেন করার পর ক্যানসার ধরা পড়লে...

ডাক্তার আরও কী কী যেন বলে গেলেন। মাথায় কিচ্ছু ঢুকল না। ঘোর কিছুটা কাটার পর দেখি, স্ট্রেচারে শোয়া আমি অপারেশনকক্ষের সামনে। মনজুর এগিয়ে এসে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। কত কথা যে বলতে মন চাইছে! কিছুই বলা হলো না! আমি অপারেশনকক্ষে ঢুকে গেলাম। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টায়।

জ্ঞান ফেরার পর ঝাপসা চোখে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে জানতে চাইলাম, অপারেশন শেষ? সিস্টার বললেন, হ্যাঁ, তুমি সিসিইউতে।

বেঁচে আছি, স্বস্তির এই নিশ্বাসটুকু নিতে না নিতে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম সারা শরীরে অজস্র নল আর যন্ত্রপাতি লাগানো। থুতনির নিচটা সেলাই দিয়ে বুকের সঙ্গে আটকানো। পরদিন দুপুরে যন্ত্রপাতি খুলে আমাকে কেবিনে নেওয়া হলো। জানতে পারলাম, এ ধরনের অপারেশন এখানে তাঁরা এই প্রথম করেছেন।

আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছি। একা একা চলাফেরাও করতে পারছি। কিন্তু মাথা হেলে রইল নিচে। একটু হাঁটলেই ব্যথায় ঘাড় অবশ হয়ে যায়। ঘুমকাতুরে আমি ওষুধ খেয়েও রাতে ঘুমাতে পারি না। ক্যানসারের জন্য বায়োপসির রিপোর্ট এল ২২ অক্টোবর বিকেলে। ক্যানসার নেই। ডাক্তার বললেন, খুবই বিরল একটা ঘটনা। এ ধরনের ক্ষেত্রে ক্যানসারের আশঙ্কাই থাকে বেশি।

২৮ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। এর আগেই অবশ্য থুতনি আর গলার সেলাই কেটে দেওয়া হয়েছে। বারবার করে তাঁরা সাবধান করে দিয়েছেন, চক্ষুঃসীমার ওপরে যেন আমি কিছুতেই না তাকাই।

৩ নভেম্বর ব্রঙ্কোস্কোপি করার পর ডাক্তার জানালেন, আমি এখন উড়োজাহাজে উড়তে পারব। পরদিনই আমরা রওনা দিলাম। বাচ্চাদের একনজর দেখার জন্য সময় যেন আর কাটছে না। পাইলট যখন বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঢাকায় নামছি, কিছুতেই আমি কান্না চেপে রাখতে পারলাম না।

দুই বাচ্চা আমাকে রিসিভ করতে এসেছে। ওদের বুকে জড়িয়ে ধরে আমি চিৎকার করে কাঁদছি। খুবই অবাক হয়ে ওরা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তো ভালো হয়ে গেছ। তাহলে কাঁদছ কেন, মামণি?’