‘অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী অন্তত সাতটি তারবার্তা পাঠান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। ১৬ আগস্ট এ সম্পর্কে প্রাথমিক মন্তব্য শীর্ষক বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৫ আগস্ট স্থানীয় সময় ভোর সোয়া পাঁচটায় অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পরের ঘটনা এই আশাবাদ সৃষ্টি করেছে যে এ অভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ করা হবে না।’

ওই সময় ওয়াশিংটনেও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকার খবর জানতে উদ্‌গ্রীব ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার ১১-১২ ঘণ্টা পর তিনি তাঁর স্টাফ বৈঠকে উল্লেখ করেন, ‘আমি আইএনআর (ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ) থেকে এ বিষয়ে ভালো তথ্য পাই।’ এ সময় ব্যুরোর পরিচালক উইলিয়াম জি হিল্যান্ড বলেন, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলি, মুজিব তখনো মারা যাননি।’ সিআইএর সাবেক চৌকস কর্মকর্তা হিল্যান্ড ৭৯ বছর বয়সে গত বছরের ২৫ মার্চ মারা যান। ‘তিনি ছিলেন এক ভালো বিশ্লেষক। আমাদের গ্রুপে তিনি ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তাঁর মৃত্যুর পর এ মন্তব্য করেন কিসিঞ্জার (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৮ মার্চ ২০০৮)। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটন সময় সকাল আটটার আগে মুজিবের মৃত্যুর বিষয়ে কিসিঞ্জার-হিল্যান্ড কথোপকথনের বিস্তারিত জানা যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

তবে ১৫ আগস্ট কিসিঞ্জার যখন তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে শুনলেন, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ছিল সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত, তাৎক্ষণিক বললেন, ‘তার মানে কী? মুজিবুর কি জীবিত, না মৃত?’ নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড আথারটন এ সময় বলেন, ‘মুজিবুর নিহত। তাঁর নিকটতম আত্মীয়স্বজন, যাঁদের অধিকাংশই পরিবারের সদস্য, তাঁরা বেঁচে নেই।’ এ-সংক্রান্ত দলিল থেকে জানা যাচ্ছে, হার্ভার্ড স্নাতকোত্তর ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আথারটন এবং ১৯৬৯ পর্যন্ত সিআইএতে থাকা হিল্যান্ড বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানের খুঁটিনাটি জানতেন। ১৯৬২-৬৫ সালে কলকাতায় কর্মরত আথারটন ২০০২ সালের ৩০ অক্টোবর মারা গেছেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি মিসরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ হিল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে খ্যাতি কুড়ান। তিনি ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনের সম্পাদকও ছিলেন।

ওই দিন হিল্যান্ডের মুখে ‘মুজিব তখনো মারা যাননি’ শুনে কিসিঞ্জার পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সত্যিই তাই? তারা তাহলে মুজিবকে কিছু সময় পরে হত্যা করেছিল?’ এর জবাব দেন নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন। তিনি বলেন, ‘আমরা যত দূর জানি—আমি বলতে পারি না যে আমরা বিস্তারিত সবকিছু জেনে গেছি। কিন্তু ইঙ্গিত ছিল তাঁকে হত্যা পরিকল্পনা বিষয়েই। এবং তারা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে। ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁকে হত্যা করে।’

লক্ষণীয়, বোস্টারের পাঠানো তারবার্তাগুলোয় বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে যে তিনি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সংবেদনশীল ও সতর্ক ছিলেন। তিনি ১৬ আগস্ট লিখেছেন, ‘জনসাধারণ যদিও মুজিবের পতনে আনন্দ প্রকাশ করেনি কিন্তু গ্রহণসূচক শান্ত অবস্থা বজায় রয়েছে এবং সম্ভবত তাতে স্বস্তির নিশ্বাসও রয়েছে। শেখ মুজিব ও বাঙালিরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে তাঁর ব্যর্থতা। এবং দৃশ্যত তাঁর ক্ষমতায় থাকাটা হয়ে পড়েছিল মূলত ব্যক্তিগত ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয় “ডাইন্যাস্টিক রিজনস” অর্থাৎ রাজবংশীয় শাসকদের পরম্পরাসংক্রান্ত কারণ। বাঙালিদের কাছ থেকে মুজিবের বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বাড়ার বড় কারণ ছিল তিনি যথাযথ পরামর্শ গ্রহণ থেকে দূরে সরছিলেন। এমনকি মুজিবের মধ্যে স্বৈরশাসকের চিরায়ত বৈকল্য ফুটে উঠতে শুরু করেছিল।’ 

বোস্টারের কথায়, ‘জুনের গোড়া থেকে শেখ মুজিব ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর ভাগনে শেখ মনির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এসবই অভ্যুত্থানকারীদের সন্দেহমুক্ত করে যে পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব করা আর সমীচীন হবে না। তবে অভ্যুত্থানের জন্য ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস বেছে নেওয়ার বিষয়টি হয়তো শুধুই কাকতালীয়। এই কাকতালীয় বিষয়টি কিন্তু আমাদের বিবেচনায় লক্ষণীয়।’

বোস্টার এরপর লেখেন, ‘এটা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার সামান্যই উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পেরেছে। যদিও শেখ মুজিবের সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের অনেকেই হত্যার শিকার কিংবা বাদ পড়েছেন। কিন্তু তারপরও বর্তমান সরকারে সেসব পরিচিত মুখই রয়ে গেছেন, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্বল প্রশাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। স্পষ্টতই মন্ত্রিসভায় এখন যাঁরা রয়ে গেছেন, তা থেকে মনে হয়, মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলবে। কিন্তু সেখানে বৃহত্তর মডারেশন থাকবে। ১৫ আগস্ট দেওয়া তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে। শেখ মুজিবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের নিন্দা করলেও মোশতাক জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা অনেকটাই অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যেই কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যে নতুন সরকার পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইবে। মোশতাকের সঙ্গে ভারতের সদ্ভাব না থাকার বিষয়টি প্রকাশ্য বিষয় হলেও এটাও পরিষ্কার যে নতুন সরকার ভারতের মনে বাড়তি কোনো সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার দিকে যাবে না। মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার দিকে তাকালে সেই ইঙ্গিত মেলে। পুরোনো মুখগুলো রেখে দেওয়ার পেছনে নতুন সরকার কার্যত ভারতের কাছে সেই বার্তাই পৌঁছে দিতে চায়। মোশতাকের ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিত মেলে। এভাবে সরকার সোভিয়েত প্রভাব কিছুটা স্তিমিত করতে চাইছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রভাব সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে বোস্টার লিখেছেন, ‘নতুন সরকারের সঙ্গে আমাদের নিজেদের সম্পর্ক মুজিব সরকারের চেয়ে “এমনকি আরও অন্তরঙ্গ ভিত্তি”র ওপর প্রতিষ্ঠা পাবে। নতুন রাষ্ট্রপতি অতীতে অত্যন্ত লক্ষণীয় ও প্রকাশ্যে “প্রো–আমেরিকান” দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বড় কথা হচ্ছে, মুজিব সরকারের মধ্যে শেখ মনি ও সামাদের (আবদুস সামাদ আজাদ) মতো যাঁরা বামপন্থী ও আমেরিকাবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা আর নেই। আরও জোরালো সম্ভাবনা হচ্ছে, বাংলাদেশ আমাদের কাছে এখন বেশি পরিমাণে সাহায্য চাইতে পারে। ইতিপূর্বে মোশতাক আমাদের বলেছিলেন, শুধু আমেরিকাই আমাদের সত্যিকারের সাহায্য করতে পারে। সুতরাং আমাদের প্রতি নতুন সরকারের উচ্চাশার বাঁধ নিয়ন্ত্রণই হতে পারে বড় সমস্যা।’

মোশতাক সরকার এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইউজিন বোস্টার লক্ষণীয়ভাবে উল্লেখ করেন, ‘এটা আমরা বিচার করতে পারি না।’ তাঁর কথায়, ‘আমরা কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করি যে প্রত্যেক সরকারি বিবৃতিতে ক্ষমতা গ্রহণের অনুকূলে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হচ্ছে। আমাদের বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী বর্তমানে সামরিক আইন আদেশ এমএলও প্রস্তুত করছে এবং এ ক্ষেত্রে যদি পাকিস্তানি ধাঁচ অনুসরণ করা হয়, তবে তা-ই হবে দেশের আইনের ভিত্তি। এর ফলে সামরিক ও বেসামরিক লোকের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে কি না, তা আমরা এখন বলতে পারি না। কিন্তু আমরা এটা ভাবতে পারি, মোশতাক বিবৃতিতে ইতিমধ্যে যা বলেছেন, তাতে গত জানুয়ারিতে মুজিব যা চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তার চেয়ে একটি নতুন ও অধিকতর উদার সংবিধান পাওয়া যাবে।’

বোস্টার এ পর্যায়ে আরও উল্লেখ করেন, ‘মুজিবকে উৎখাতে সামরিক বাহিনীর সাফল্যের প্রেক্ষাপটে আমাদের এই ধারণা জন্মেছে যে অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি। যাহোক, সামরিক বাহিনী—বিশেষ করে যেসব তরুণ কর্মকর্তা, যাঁরা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরাই শেখ মুজিবকে উৎখাত করেছেন এবং আমরা সন্দেহ করি এবং যেহেতু তাঁরা রক্তের স্বাদ পেয়েছেন, তখন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তাঁরা কিছু ভূমিকা রাখতে চাইবেন। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে কোনো বাঙালি গাদ্দাফিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। তার চেয়ে বরং এটা ভাবাই সংগত যে চাকরিমুখো মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরোনো সদস্য—যাঁরা শেখ মুজিব দ্বারা হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা হয়তো একটি অধিকতর উদারপন্থী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন। পাকিস্তানি জমানায় পূর্ব বাংলায় যেমনটা দেখা গিয়েছিল, তার চেয়ে এটা হতে পারে ভিন্ন।’

বোস্টার লেখেন, ‘এখানে একটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা উচিত যে রক্তস্নাত হলেও শেখ মুজিবের উৎখাত যখন সফল হয়েছে, তখন আরও অনেক কিছুই করা বাকি রয়েছে। মোশতাকের ভাষণ প্রধানত সাধারণ বিবরণগত দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ এবং এতে আওয়ামী লীগের ইতিপূর্বেকার বাগাড়ম্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে কিন্তু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ এ পর্যন্ত যা নেওয়া হয়েছে, তা অল্পই। দেশ পরিচালনায় সীমিত পদক্ষেপ দেখে আমরা বিস্মিত হইনি। তবে যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে নতুন সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে শুরু করবে। সে ক্ষেত্রে আমরা খুবই অস্থিরতাপূর্ণ একটি ক্ষমতার লড়াই প্রত্যক্ষ করতে পারি। বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে শেখ মুজিবের মতো আজ আর কোনো কমান্ডিং পারসোনালিটি বা আদেশদানকারী ব্যক্তিত্ব নেই, যা কিনা মুজিবকে দীর্ঘকাল টিকিয়ে রেখেছিল। বেসামরিক সরকারের পদস্খলন ঘটেছে। আমরা এখন সামরিক বাহিনীর দিকে তাকাতে পারি। জাতিকে বাঁচাতে সেটাই আবশ্যিক।’

প্রথম আলো, ১২ আগস্ট, ২০০৯