কেন্দ্রে নৌকার কর্মীদের আধিপত্য, গোপন কক্ষে বাটন টিপে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ

ভোটার–খরা, নেই নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্টও। আজ বেলা দেড়টায় চট্টগ্রাম নগরের মোহরা ছায়েরা খাতুন কাদেরীরা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কেন্দ্রে
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের উপনির্বাচনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল নৌকার প্রার্থীর অনুসারীদের দাপট। ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, হুমকি, গোপন কক্ষে ঢুকে বাটন টিপে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ।

তবে নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলছেন, ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা আসেননি।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় এ উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। আসনের বোয়ালখালী অংশে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে নৌকার সমর্থকদের আধিপত্য চোখে পড়ে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী নোমান আল মাহমুদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী ফ্রন্টের সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদ সকাল থেকেই কেন্দ্রে তাঁর এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া ও গোপন কক্ষে বাটন টিপে দেওয়ার অভিযোগ করে এসেছেন।

বেঙ্গুরা কে বি কে আর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে মোমবাতিতে ভোট দেওয়ার অপরাধে তাজুল ইসলাম নামের ইসলামী ফ্রন্টের এক নেতাকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন ফ্রন্ট প্রার্থী সেহাব উদ্দিন। এতে ওই নেতার হাত কেটে যায়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্বাস উদ্দিন ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. সেলিম এ মারধর করেন বলে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দেন তাঁরা।

এ ছাড়া চরণদ্বীপ আব্বাসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেলা আড়াইটার দিকে ইসলামী ফ্রন্টের নেতা সুমন ফারুকীকে মেরে জখম করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। একই ঘটনায় হারুনুর রশিদ ও মো. তারেক নামের দুজন ফ্রন্ট কর্মী আহত হন। মোমবাতিতে ভোট দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ।

ভোটকক্ষে কেউ কেউ এভাবে অন্যের ভোট দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন অনেক ভোটার। আজ বেলা দেড়টায় বোয়ালখালীর সারোয়াতলী ইব্রাহীম নুর মোহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে
ছবি: সৌরভ দাশ

সরেজমিনে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও নৌকার প্রার্থীর এজেন্টরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে আসা–যাওয়া করছেন। তাঁদের কেউ কেউ ভোটারের সঙ্গে ভোট প্রদানের গোপন কক্ষেও ঢুকছেন।

বেলা ১১টায় পোপাদিয়া ওয়ারেছ মোহছেনা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, নৌকা প্রতীক ছাড়া মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রতীকের এজেন্ট নেই। এজেন্ট না থাকার বিষয়ে লিটন কুমার চৌধুরী নামের এক নির্বাচনী কর্মকর্তার ভাষ্য, কেউ আসেননি।

এই কেন্দ্রে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা মেজবাহ উদ্দিন ভোটারদের আনা–নেওয়ার বিষয়টি তদারক করছিলেন। ভেতরে গোপন কক্ষে ঢুকছিলেন নৌকার এজেন্টরা। তবে কারও নৌকার ব্যাজ নেই। এজেন্টদের বুকেও নেই পরিচিতি ফলক। এটা এবারের নির্বাচনে নতুন চিত্র।

নৌকা ছাড়া অন্য প্রার্থীর এজেন্টশূন্য ভোটের কক্ষ। আজ দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরের আলহাজ আনোয়ারা বেগম উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

অথচ এক মাস আগে অনুষ্ঠিত বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনে প্রতি কেন্দ্রে নৌকার এজেন্ট ও অনুসারীদের কাছে ছাপানো নামফলক ছিল। একটি কেন্দ্র থেকে ইভিএম প্যানেল নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময়ও গলায় ঝোলানো ছিল নামফলক। গোপন কক্ষে যাওয়া–আসার সময়ও ছিল নৌকার নামফলক।

পোপাদিয়া শহীদ রফিক স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, ভোটের সব কক্ষে নৌকার এজেন্টের পাশাপাশি বহিরাগত দু-একজন করে ভোটারদের প্রভাবিত করছেন। এই কেন্দ্রের গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক অপর এক ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কক্ষের বাইরে থেকে গোপন কক্ষে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতির ছবি তুলতে গেলে বাধা দেন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য। এই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. আলমগীর। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা উৎপল রায় বলেন, ভোটার আসছেন এক–দুজন করে। অন্য কারও এজেন্ট আসেননি, নৌকা ছাড়া।

পোপাদিয়া খাজা গরিবে নেওয়াজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন শ্রমিক লীগ নেতা নুরুল ইসলাম। এ কেন্দ্রের আটটি কক্ষের মধ্যে পাঁচটিতে মোমবাতি প্রতীকের এজেন্ট ঢুকতে পেরেছিলেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কফিল উদ্দিন ও হাসিনা আকাতার নামের দুজন বের হয়ে যান। কফিল উদ্দিন অভিযোগ করেন, তাঁর স্ত্রী হাসিনা আকতার মোমবাতির এজেন্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভোট নৌকায় টিপে দেন নৌকার একজন অনুসারী। এ ছাড়া হুমকির কারণে তাঁরা কেন্দ্র ছেড়ে চলে আসেন।

গোপন ভোটকক্ষে অন্য ব্যক্তির আনাগোনা। আজ বেলা দেড়টায় বোয়ালখালীর সারোয়াতলী ইব্রাহীম নুর মোহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

পশ্চিম সারোয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা পৌনে একটায় দেখা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মনসুর সিকদার নারী ভোটারদের কক্ষে একবার যাচ্ছেন আর বের হচ্ছেন। ভোটারদের নিয়ে তিনি কেন্দ্রে গিয়ে গোপন কক্ষে ঢুকছেন। এ সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হন। পরে মনসুর সিকদার বলেন, তাঁর আত্মীয়কে ভোটদানে সহযোগিতার জন্য গোপন কক্ষে গিয়েছিলেন।

একই কেন্দ্রের অপর একটি কক্ষে নৌকার এজেন্ট ছিলেন এস এম বাবু। সেখানেও নারী ভোটারদের সঙ্গে বারবার তিনি গোপন কক্ষে ঢুকছিলেন। এস এম বাবু বলেন, ‘আমি তাঁদের দেখিয়ে দিচ্ছিলাম, কীভাবে ভোট দিতে হবে।’

এর আগে সকাল সাড়ে নয়টায় গোমদণ্ডী পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি রেজাউল করিম তাঁর দলবলসহ উপস্থিত রয়েছেন। তাঁরা কেন্দ্রে অবাধে ঢুকছিলেন, বের হচ্ছিলেন। রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কেন্দ্রের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন। তাই কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করছেন। কোনো প্রভাব বিস্তার করছেন না।

সিডিএ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রেও ভোটার দেখা গেছে কম। আজ বেলা সাড়ে ১১টায়
ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ করে ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদ বলেন, বাটন টিপে দেওয়া, যখন-তখন কেন্দ্রে একটি দলের নেতা-পাতিনেতাদের প্রবেশ সর্বোপরি অন্য দলের এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৭ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘এ ভোট কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। রিটার্নিং কর্মকর্তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড নির্বাচনকে কলুষিত করেছে।’

এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। জানতে চাইলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত চলছে। আবার কোনো কোনো অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। তবে ভোটে তেমন কোনো বিশৃঙ্খলা শুনিনি। এখন তাঁরা পুনরায় ভোট দাবি করতেই পারেন।’

আরও পড়ুন