জাতীয় চার নেতার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির দাবি

বাবা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন মেয়ে শারমিন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, আগারগাঁও। ৮ নভেম্বর
ছবি: আশরাফুল আলম

নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চার নেতার অবদান ও আত্মত্যাগের কথা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁদের সন্তান ও পরিবার। আজ বুধবার দুপুরে আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘জাতীয় চার নেতা স্মরণ’ অনুষ্ঠানে তাঁরা এই আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানের আয়োজক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইতিমধ্যেই জাতীয় চার নেতার বিভিন্ন স্মারক নিদর্শন ও অবদানের বিবরণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি বিশেষ কর্নার করা হবে। ট্রাস্টি ও অনুষ্ঠানের সভাপতি সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর জানান, এ জন্য কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বছরের এপ্রিল মাসে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে এই কর্নারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ শহীদ চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে আন্দোলন করেছেন। আবার যুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকার গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্যের ব্যবস্থা করা, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনার মতো কাজগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। এ কারণেই অল্প সময়ে আমাদের পক্ষে যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। তাঁদের প্রতি সম্মান জানানো ও অবদানের কথা জাতির সামনে তুলে ধরতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানটি ছিল স্মৃতিচারণামূলক। বক্তারা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর জাতীয় চার নেতাকে সপরিবার গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁদের কাছে মোশতাক আহমদের পক্ষ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু তাঁরা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা ও আনুগত্যে অবিচল থেকেছেন। তাঁদের সবাইকেই ২২ আগস্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং নভেম্বরের ৩ তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর ইতিহাসের এক নষ্ট সময়। জাতীয় চার নেতা জীবিত থাকলে এই সময়টি নষ্ট হতো না। ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। সে কারণেই ঘাতকেরা তাঁদের হত্যা করেছিল।

জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি বিশেষ কর্নার করার কথা জানান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আসাদুজ্জামান নূর জানান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, আগারগাঁও। ৮ নভেম্বর
ছবি: আশরাফুল আলম

সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে সংসদ সদস্য সৈয়দা জাকিয়া নূর তাঁর বাবার দীর্ঘ স্মৃতিচারণা করে বলেন, খন্দকার মোশতাক প্রথমে তাঁর বাবাকে টেলিফোন করে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলেন। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দেন, মৃত্যুবরণ করবেন, তবু বঙ্গবন্ধুর লাশের ওপর দিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। পরে তাঁর মাকে ফোন করা হলেও মা-ও একই কথাই বলেছিলেন। তখন মোশতাক তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর আর কিছু করার নেই, যা হওয়ার তা-ই হবে।

জাকিয়া নূর আক্ষেপ করে বলেন, বাবার হত্যার বিচারের জন্য তাঁরা দ্বারে দ্বারে গেছেন। ২০১৩ সালে জেলহত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু তাঁর মা সেই বিচার দেখে যেতে পারেননি। গভীর আক্ষেপ আর বেদনা নিয়ে তিনি চিরতরে চলে গেছেন।

তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদও বাবাকে নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণা ও পরে জেলহত্যা নিয়ে তাঁর গবেষণার কথা উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, নতুন করে আবার জেলহত্যার বিচার হওয়া উচিত। কারণ, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খুনিদের দুটি দল কারাগারে গিয়েছিল। প্রথম দলটি খুন করে ফিরে যায়। এই দলেরই বিচার হয়েছে। কিন্তু তারপর আরও একটি দল গিয়ে মরদেহে বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। অনেক গবেষণায় ও বিবরণে দলের কথা এসেছে। তবে এই দ্বিতীয় দলটিতে কারা ছিল, তা স্পষ্ট নয়। সে কারণেই তাদের পরিচয় শনাক্ত করে সাজার আওতায় আনার জন্য নতুন করে বিচার হওয়া প্রয়োজন।

ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর পৌত্র সংসদ সদস্য তানভির শাকিল বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জেলহত্যার বিচার হলেও এখনো সবার সাজা কার্যকর করা হয়নি। খুনিদের অনেকে বিদেশে বীরদর্পে রয়েছেন। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার জন্য তিনি দেশে-বিদেশে একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি জেলহত্যার নেপথ্যে ব্যক্তিদের বের করে আনতে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেন।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল শিল্পী বুলবুল ইসলামের গাওয়া ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে...’ গানটি দিয়ে। আলোচনার ফাঁকে কবি শামসুর রাহমানের ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন গোলাম সারোয়ার। সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম।

সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেশের জনগণের প্রতিষ্ঠান। সবাইকে নিয়েই জাদুঘর এ ধরনের কাজ চালিয়ে যাবে।