গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে জোর

জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আলোচনা। 

আনিসুল হক

বাংলাদেশ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধীদের সব রকম অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং বিরোধী দল পার্লামেন্টে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে গতকাল সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যালোচনা সভায় মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। জেনেভায় চলমান জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের চতুর্থ ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আলোচনার শুরুতে আইনমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মানবাধিকারের মৌলিক নীতিমালা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর।

পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ লিখিতভাবে যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, আইনমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে মূলত তারই পুনরাবৃত্তি করেন। সভায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে নির্বাচন, রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উত্থাপন করেন। আইনমন্ত্রী সেসবের জবাব দেন। 

পাশাপাশি আইনমন্ত্রী এমন কিছু রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরেন, যা নিয়ে কোনো দেশই কিছু বলেনি। সেগুলোর মধ্যে ছিল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, বিএনপির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসাজনিত শর্তাধীন মুক্তি, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা এবং মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও তার প্রধান আদিলুর রহমান খান সম্পর্কে সরকারের অবস্থানের ব্যাখ্যা।

সভায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো এবং অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন ও চিন্তার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহির ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিপরীতে উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে চীন, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

বাংলাদেশের এই চতুর্থ ইউপিআরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুপারিশ করে। একই সঙ্গে গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর এবং গুমের অভিযোগগুলোর স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানায়। নির্যাতনবিরোধী সনদ কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারের (সিএটি) অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষরের সুপারিশও করে অনেক দেশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে আনা সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিষয়েও আলোচনা হয়। নতুন এই আইনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত করবে বলে অভিমত দেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনগুলোর সঙ্গে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সংশোধন করা দরকার। এর মধ্যে কানাডার প্রতিনিধি সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানান।

■ বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যালোচনায় ১১৮টি দেশের অংশগ্রহণ।

■ পর্যালোচনা সভার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব পড়েছে পাকিস্তান, কিউবা ও রুমানিয়ার ওপর। 

■ আগামীকাল বুধবার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
এরপর সুপারিশমালা গৃহীত হওয়ার কথা। 

■ চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রকাশ করা হবে ২৪ নভেম্বর। 

মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, এসব অধিকার সীমাহীন নয়, নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এ আইন করার উদ্দেশ্য সাইবারজগৎকে নিরাপদ রাখা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার যে বিধান ছিল, নতুন আইনে তা নেই। ভিন্নমতের প্রকাশ এ আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

নির্বাচন ও বিরোধী দল

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তাঁর সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। তিনি বাংলাদেশের প্রতিবেদনে তুলে ধরা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের সংশোধনীর কথা পুনরুল্লেখ করেন। 

বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রসঙ্গ তুলে আইনমন্ত্রী বলেন, তাদের সময়ে ভোট কারচুপির কারণে ওই ব্যবস্থা চালুর আইনটি হয়েছিল। আদালত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করেছেন এবং সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার অবসান ঘটেছে। তিনি বলেন, বিএনপির প্রতি সরকার উদারতা দেখিয়েছে, অথচ তারা সহিংসতার পথ নিয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেন, বিএনপি পুলিশ হত্যা করেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবন তছনছ করেছে, সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে।

আনিসুল হক বলেন, সরকার যথেচ্ছ গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে না। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

ইউপিআর অধিবেশনের পরপর জাতিসংঘ দপ্তরেই কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের আয়োজনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া বাকনার আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বলেন, গত দুই সপ্তাহে ১০ হাজারের বেশি বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি মৃত ও দেশে অনুপস্থিত মানুষের নামেও ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে জেনেভার বাংলাদেশ মিশনের একাধিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান সঞ্চিতা হক তাঁর বক্তব্যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।

ইউপিআরের মূল অধিবেশনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খালেদা জিয়ার মামলা ও চিকিৎসার প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, অনেকে তাঁকে গৃহবন্দী বলে থাকেন বিধায় তিনি জানিয়ে রাখতে চান যে বিএনপি নেত্রী দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত এবং মামলাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হয়েছিল। তিনি বলেন, তাঁর পরিবারের আবেদনের পর সরকার তাঁকে চিকিৎসার জন্য সাময়িক মুক্তি দেয় এবং এ পর্যন্ত সাতবার তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তিনি দেশে সর্বোত্তম চিকিৎসা পাচ্ছেন।

আইনমন্ত্রী গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা ও তথ্য আদান–প্রদানের কথা বলেছেন। ওই কমিটির সদস্য এবং মানবাধিকারের কিছু বিষয়ে ম্যান্ডেটধারী স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর প্রশ্নে তিনি বলেন, গত ইউপিআরের পর রেকর্ডসংখ্যক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারদের বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছে। তিনি অবশ্য তাঁর মুক্তির শর্তের বিষয়ে কিছুই বলেননি।

শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার

আইনমন্ত্রী তাঁর সূচনা বক্তব্যে পোশাকশ্রমিক বিক্ষোভকে নাশকতা আখ্যা দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করাই এর উদ্দেশ্য। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সরকার শ্রম আইন সংস্কার করেছে এবং গত সপ্তাহে পোশাকশিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পরে এক্সে (সাবেক টুইটার) এক বার্তায় বলে, বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার।

ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজ করা হয়েছে বলে আইনমন্ত্রী জানান। এই সূত্রে ড. ইউনূসের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার বিধান না মানায় শ্রমিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করায় সরকার তাতে সমর্থন দিচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জুলিয়া বাকনার ইউপিআর অধিবেশনের পরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আলাদা অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাকে নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধে সরকারের ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির অংশ বলে অভিহিত করেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এ সভায় বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সরকার–সমর্থক তিন–চারজন প্রবাসী তাঁকে হেনস্তা করেন।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের সুপারিশে নাগরিকদের ভোটের অধিকারকে সুরক্ষা, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচারের ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানায়।

যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেন। তিনি মতপ্রকাশের, সংগঠন ও সমাবেশের এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেন।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যালোচনায় ১১৮টি দেশ অংশগ্রহণ করেছে। এ পর্যালোচনা সভার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব পড়েছে পাকিস্তান, কিউবা ও রুমানিয়ার ওপর। আগামীকাল বুধবার দুপুরে তারা এ প্রতিবেদন পেশ করবে। এরপর সুপারিশমালা গৃহীত হওয়ার কথা। চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রকাশ করা হবে ২৪ নভেম্বর।