চট্টগ্রামে খাল–নালায় মানুষ মরছে, তবু নিরাপত্তাবেষ্টনী উঠছে না

প্রতিবছর বর্ষা এলে নালা বা খালে তলিয়ে গিয়ে মারা যান মানুষ। কিন্তু এসব দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত চশমা খালে নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী। আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম মুরাদপুর মোড়ের এক পাশে চশমা খাল, আরেক পাশে নালা। নালার বিভিন্ন অংশ উন্মুক্ত, কোনো স্ল্যাব নেই। নালার সঙ্গে লাগোয়া ফুটপাত। বর্ষায় নালার পানি চলে আসে সড়কে। তখন নালা আর সড়ক আলাদা করার উপায় থাকে না। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে এ নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন পথচারী আবু দাউদ। উন্মুক্ত নালার ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বলেন, খাল-নালায় পড়ে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। কিন্তু কারও টনক নড়ছে না। এখনো নগরের বেশির ভাগ খাল-নালা উন্মুক্ত। যেখানে স্ল্যাব বসানোর উপায় নেই, সেখানে বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করা উচিত।

শুধু আবু দাউদ নন, নিরাপত্তাবেষ্টনীহীন খাল-নালার ঝুঁকি নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরের বেশির ভাগ বাসিন্দা। সর্বশেষ দেড় বছর বয়সী এক শিশুর নালায় পড়ে মৃত্যুর পর ক্ষোভ আরও বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে লেখালেখি করছেন অনেকে।

গত রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকার একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। ১৬ ঘণ্টা পর নালার আবর্জনার নিচ থেকে ইয়াছিনের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়।

রঙ্গীপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, সরু গলির ভেতর দিয়ে প্রায় চার ফুট প্রস্থের একটি নালা চলে গেছে। নালাটি গিয়ে মিশেছে মহেশ খালে। নালার কোনো অংশে স্ল্যাব আছে, কোনো অংশে নেই। শিশু ইয়াছিন আরাফাতের বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে উন্মুক্ত অংশে চলে গিয়েছিল। পরে সেখানে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

এ বছর চট্টগ্রামে নালায় পড়ে ইয়াছিনসহ দুজনের মৃত্যু হলো। এর আগে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামি হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকার নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)। ২০২১ সালের ৩০ জুন মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। তাঁর মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি।

এরপর ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার।

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকার এই স্থানে নালায় স্ল্যাব না থাকায় পড়ে মারা গেছে শিশু ইয়াছিন আরাফাত। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায়
ছবি: সৌরভ দাশ

ঝুঁকি নিয়ে পথচলা
প্রতিটি মৃত্যুর পর খাল-নালায় প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার দাবি জানানো হয়। কিন্তু বছর ঘুরে আবার দুর্ঘটনা হলেও ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে হয় নগরবাসীকে। আজ নগরের মুরাদপুর ছাড়াও বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, ২ নম্বর গেট, মেয়র গলি, আল ফালাহ গলি, মেহেদিবাগ, বাকলিয়া ঘুরে দেখা গেছে, নালার ওপর কোথাও স্ল্যাব আছে, কোথাও নেই। আবার কোথাও স্ল্যাব ভাঙা। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী। গত এক মাসে জলাবদ্ধতায় অন্তত আটবার ডুবেছে এসব এলাকা। এ কারণে নগরবাসীর মনে ভয় আরও বেড়েছে।

পশ্চিম বাকলিয়ার রূপনগর এলাকায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় পথচারী মোহাম্মদ মমিনের সঙ্গে। তিনি পেশায় পোশাকশ্রমিক। তাঁর বাসার পাশেই নালা। নালার পাশে সড়ক। মমিন বলেন, বৃষ্টি হলেই সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। তখন কোনটা নালা, আর কোনটা সড়ক তা বোঝা যায় না।

মেয়র গলি এলাকার বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষায় চশমা খাল ফুলে–ফেঁপে ওঠে। এই খালে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। কিন্তু এখনো খালের অনেক অংশের পাশেই গাড়ি চলে। মানুষ হাঁটাচলা করে। মূলত বর্ষাতেই ঝুঁকিটা বাড়ে। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

ভারী বৃষ্টি হলে এই সড়ক আর খালে কোনো তফাত থাকে না। রাস্তা ভেবে খালে পা ফেলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত চশমা খাল। আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটায়
ছবি: সৌরভ দাশ

দায় নেয় না কেউ
নগরের উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)—কেউ সরাসরি এর দায় নেয়নি। এসব মৃত্যুর জন্য উল্টো পরস্পরকে দায়ী করে আসছে সংস্থা দুটি। সর্বশেষ শিশু মৃত্যুর বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম (দোভাষ) প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি যে নালায় পড়েছে, সেটি দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আর চশমা খালে জলাবদ্ধতার প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে দেওয়া হবে।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্ল্যাব মেরামত ও নির্মাণ ধারাবাহিকভাবে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু নালায় স্ল্যাব বসানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানের খালেও বেষ্টনী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। শিগগির বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নালা চিহ্নিত করে স্ল্যাব বসানো হবে।

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, পথচারীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য গত তিন বছরে প্রায় ২৫ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত এবং নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ খালের পাড়ে ১৫ হাজার বর্গফুট রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখনো নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নালা-নর্দমায় কয়েক হাজার মরণফাঁদ রয়েছে। আর পথচারীদের চলাচল নিরাপদ করতে খালের পাড়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী দরকার ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। তালিকা তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত নালা-নর্দমা ও খালের পাড় ঝুঁকিমুক্ত করার কাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন।

খাল-নালা ঝুঁকিমুক্ত না হওয়ার জন্য সিডিএ-সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, খাল-নালায় পড়ে কেউ মারা গেলে দু-চার দিন আলোচনা হয়। এরপর আবার সব থেমে যায়। কিন্তু এসব উন্মুক্ত খাল-নালাকে ঝুঁকিমুক্ত করা হয় না। তাই আর বিলম্ব না করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। খালের পাড়ে এবং নালা ও ফুটপাতের মাঝখানের অংশে রেলিং কিংবা লোহার দিয়ে বেষ্টনী দিতে হবে।