স্মার্ট হোম: আবাসন খাতে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটছে যেভাবে
আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবক্ষেত্রেই বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। পিছিয়ে নেই আবাসন খাতও। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের আবাসন খাত ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। একসময় যেখানে একটি ফ্ল্যাট বা বাড়ি মানেই ছিল চার দেয়ালের একটি আশ্রয়স্থলমাত্র, সেখানে এখন মানুষ খুঁজছে নিরাপত্তা, আরাম এবং প্রযুক্তির সমন্বিত সমাধান। নগরায়ণের গতি বৃদ্ধি, আয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আবাসন খাতে নতুন ধারা তৈরি করছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট অব থিংস, স্মার্ট হোম ডিভাইস, স্বয়ংক্রিয় সিকিউরিটি সিস্টেম এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মানুষের আবাসস্থলকে রূপান্তরিত করছে ‘স্মার্ট হোমে’।
আবাসনে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ কী ও কেন
স্মার্ট হোমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ বা আইওটি। এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। ফলে মোবাইল অ্যাপ বা ভয়েস কমান্ড ব্যবহার করে ঘরের যন্ত্রপাতি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। যেমন অফিসে বসে বাসার এয়ারকন্ডিশনার চালু করা অথবা দেশের বাইরে থেকেও বাসার সিকিউরিটি ক্যামেরার ভিডিও দেখা এখন খুবই সহজ। আধুনিক আবাসনে ব্যবহৃত স্মার্ট ডোর লক, মোশন সেন্সর, স্বয়ংক্রিয় লাইটিং, স্মার্ট রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি এই প্রযুক্তির অংশ। এতে যেমন জীবনযাত্রায় সুবিধা বেড়েছে, তেমনি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এসেছে নতুন মাত্রা।
বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াজ লিমিটেডের (বিটিআই) নির্বাহী পরিচালক (ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশন) আয়েশা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্মার্ট হোম টেকনোলজি মূলত আপনার জীবনকে সহজ করে তোলে, ঝামেলা কমায়, সম্পদের অপচয় রোধ করে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুভমেন্ট সেন্সর প্রযুক্তি বিদ্যুৎ ও পানির মতো ইউটিলিটির অপচয় কমায়। গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর বাড়ির বাসিন্দাদের অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে। সিসিটিভি মনিটরিং বাড়ির বাইরে থেকেও প্রিয়জনদের খোঁজ রাখতে সাহায্য করে। তবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সঠিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকেও নজর দিতে হবে।’
নিরাপত্তার আধুনিক সমাধান
নগরবাসীর প্রধান উদ্বেগের একটি বিষয় হলো নিরাপত্তা। সেই কারণেই আবাসনে স্বয়ংক্রিয় সিকিউরিটি সিস্টেমের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। স্মার্ট ডোর লক, বায়োমেট্রিক অ্যাকসেস, সিসিটিভি মনিটরিং, ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি—এসব ব্যবহার করে ভবনগুলোকে নিরাপদ রাখা হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে দরজার তালা খোলা বা বন্ধ করা যায়, এমনকি কেউ বাসায় না থাকলেও অপরিচিত কেউ প্রবেশের চেষ্টা করলে সতর্কবার্তা চলে আসে মালিকের ফোনে। ডেভেলপার কোম্পানিগুলো নতুন প্রকল্পে এসব প্রযুক্তি সংযোজন করছে, যাতে ক্রেতাদের কাছে বাড়িগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্সের ব্যবহারও দ্রুত বাড়ছে। স্মার্ট রেফ্রিজারেটর খাবারের মেয়াদ শেষের নোটিফিকেশন দেয়, স্মার্ট ওভেন ইন্টারনেট থেকে রেসিপি ডাউনলোড করে রান্না করতে পারে, রোবট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘর পরিষ্কার করে, আর ভয়েস-কনট্রোলড টিভি শুধু নির্দেশ দিলেই কাজ করে। এসব প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরামদায়ক করছে এবং সময় সাশ্রয় করছে।
টেকসই আবাসনের ভিত্তি
আবাসনে প্রযুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো স্মার্ট এনার্জি ম্যানেজমেন্ট। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ভবনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে সেন্সরভিত্তিক লাইটিং, যা উপস্থিতি অনুযায়ী চালু বা বন্ধ হয়, সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি-এফিশিয়েন্ট এয়ারকন্ডিশনিং এবং বিদ্যুৎ খরচ মনিটর করার স্মার্ট সিস্টেম—এসব প্রযুক্তি ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ বিল কমে আসে, পাশাপাশি পরিবেশের ওপর চাপও হ্রাস পায়।
এ বিষয়ে বিটিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘বাংলাদেশের আধুনিক আবাসনগুলোতে স্মার্ট এনার্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ব্যবহার বাড়াতে গ্রাহকদের স্মার্ট হোমের সুবিধা, এর কার্যকারিতা এবং কীভাবে এগুলো ব্যবহার করা যায় সে বিষয়গুলো জানাতে হবে। গ্রাহকেরা এর সুবিধা পেতে শুরু করলেই ধীরে ধীরে স্মার্ট হোমের চাহিদা বাড়বে। আমাদের ডেভেলপারদেরও এসব সেবা গ্রাহকদের কাছে সহজলভ্য করে দিতে হবে, যাতে তাঁরা ব্যবহার করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে স্মার্ট হোম এবং প্রযুক্তিনির্ভর আবাসনের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। তবে এর জন্য প্রযুক্তির খরচ কমানো, স্থানীয়ভাবে স্মার্ট ডিভাইস উৎপাদন এবং দক্ষ জনবল তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করাও জরুরি, কারণ এসব প্রযুক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
বলা যায়, আবাসন খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার এখন শুধু বিলাসিতা নয়, বরং সময়ের দাবি। নিরাপত্তা, আরাম এবং শক্তি সাশ্রয়ের দিক বিবেচনা করলে ভবিষ্যতের নগরায়ণে প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট হোমই হবে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি।