দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থবির, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীন
দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি নিয়ে ১০ দিনের ব্যবধানে দুটি প্রতিবেদন সামনে এল। প্রথমটি ছিল সারা দেশের জনসংখ্যা নিয়ে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ। দ্বিতীয়টি ছিল ঢাকা শহরের জনসংখ্যা নিয়ে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) তথ্য।
দুটি প্রতিবেদনই জনসংখ্যা বিষয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার বেড়ে যাওয়ার কোনো ইতিহাস ছিল না। ইউনিসেফ ও বিবিএস বলছে, দেশের মোট প্রজনন হার বাড়ছে। মায়েরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এটা খারাপ লক্ষণ।
অন্যদিকে ঢাকায় যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস করে, তা ইকোসকের প্রতিবেদনের আগে স্পষ্ট ছিল না। ইকোসক বিশ্বের বড় শহরগুলোর জনসংখ্যার তথ্য প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ২৫ বছর আগে ঢাকা ছিল নবম। এখন ঢাকা শহরে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষের বাস। কার্যকর কর্মসূচি না থাকার কারণে দেশে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ঢাকার জনসংখ্যায়।
ইউনিসেফ ও বিবিএস বলছে, দেশের মোট প্রজনন হার বাড়ছে। মায়েরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এটা খারাপ লক্ষণ।
এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে দেখেনি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুতি পর্যন্ত মোট ১৫ বছরে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদের সভা হয়েছে মাত্র একবার। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এই নীতিনির্ধারণী পরিষদের সভা প্রতি দুই বছর অন্তর হওয়ার কথা। ২০১০ সালের ২ জুন শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘জনসংখ্যার বিষয়ে দেশের মানুষ এমনিতেই অনেক সচেতন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে কোনো সমস্যা মনে করি না।’
শেখ হাসিনার ওই বক্তব্যের প্রভাব পড়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ও মাঠপর্যায়ের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকাণ্ডে। দিন দিন মাঠপর্যায়ে কর্মী সংকট প্রকট হয়, কিন্তু নিয়োগ বন্ধ থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের পর থেকে ২০২৫ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন জাহিদ মালেক ও ডা. সামন্ত লাল সেন; কিন্তু কোনো প্রতিমন্ত্রী ছিলেন না।
ইউনিসেফ ও বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে, নারীদের গড় সন্তান জন্মদান হার বেড়েছে। ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, নারীদের গড় সন্তান জন্মদান হার বা মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর) ২ দশমিক ৪। কয়েক দশক ধরে টিএফআর কমেছে। এখন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
দেশের জনসংখ্যা এখন ১৮ কোটির বেশি। বাংলাদেশের মতো বেশি জনঘনত্বের দেশ বিশ্বে কম আছে। দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।
ইউনিসেফ ও বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে, নারীদের গড় সন্তান জন্মদান হার বেড়েছে। ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, নারীদের গড় সন্তান জন্মদান হার বা মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর) ২ দশমিক ৪। কয়েক দশক ধরে টিএফআর কমেছে। এখন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যে স্থবির, তা সরকারি কর্মকর্তাদের কথা থেকেও বোঝা যায়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফী আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে অনেক পদ খালি আছে। আবার নিয়মিত অবসরে যাচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহ কম।
মাঠে লোক নেই
অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে পদ আছে ৫৪ হাজার ২২৬টি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৯৮১টি পদে কোনো লোক নেই। অর্থাৎ প্রায় ২৮ শতাংশ পদ খালি। মাঠপর্যায়ে পদ খালি থাকলে মানুষ পরিবার পরিকল্পনা সেবা পায় না।
গ্রামাঞ্চলে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষকে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেন পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউভি)। সারা দেশে এঁদের পদ আছে সাড়ে ২৩ হাজার। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৮৮টি পদ খালি। এর অর্থ ১৮ শতাংশ এলাকায় মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়ার জনবল নেই।
পরিবারকল্যাণ সহকারীদের কাজের সমন্বয় ও নজরদারি করেন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক। এঁদের পদ আছে সাড়ে ৪ হাজার, প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে। এ রকম ৩৭৩টি ইউনিয়নে এই পদে কর্মী নেই। এসব ইউনিয়নে পরিবারকল্যাণ সহকারী থাকলেও তাঁদের কাজের ওপর কারও নজরদারি নেই।
এ ছাড়া সারা দেশে আড়াই হাজার ইউনিয়ন ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে একটি করে সাব-অ্যাসিসট্যান্স মেডিকেল অফিসারের (সাকমো) পদ আছে। ৮৭৮টি কেন্দ্রে অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ সাকমোর পদ শূন্য পড়ে আছে।
সারা দেশে পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক বা ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটরের (এফডব্লিউভি) পদ আছে ৬ হাজার ৩৬১টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৪৫টি পদ খালি পড়ে আছে। অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ পদে কোনো মানুষ নেই।
মাঠপর্যায়ে সেবার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই চার ধরনের কর্মী: পরিবারকল্যাণ সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, সাকমো এবং পরিবারকল্যাণ পরিদর্শক। দেখা যাচ্ছে, সব মিলে ৮ হাজার ২৯৩টি পদ খালি।
উপজেলায় আইইউডি ও ইমপ্ল্যান্টের সরবরাহ নেই। অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহ কম। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার দুটি ইউনিয়নে প্রয়োজনের অর্ধেক কনডম ও বড়ি আছে বলে মাঠকর্মীরা জানিয়েছেন।খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এম সুভ্রামুনিয়াম
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর টানাটানি
২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরকারি মজুত শেষের পথে’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এরপর সরকার কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কেনে। এখন আবার মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর কমতি দেখা যাচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে বিতরণ করার মতো পর্যাপ্ত কনডম নেই।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের আগে প্রতি মাসে মাঠকর্মীরা ৭০ থেকে ৮০ লাখ সুখী বড়ি বিতরণ করতেন। এখন তা কমেছে। গত অক্টোবর মাসে সুখী বড়ি বিতরণ হয় মাত্র ১৯ লাখ ৪০ হাজার। এভাবে কনডম, আইইউডি, ইমপ্ল্যান্ট, ইনজেকটেবল—সবকিছুর বিতরণই ৫০ শতাংশের মতো কমেছে।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এম সুভ্রামুনিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ আছে। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, উপজেলায় আইইউডি ও ইমপ্ল্যান্টের সরবরাহ নেই। অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহ কম। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার দুটি ইউনিয়নে প্রয়োজনের অর্ধেক কনডম ও বড়ি আছে বলে মাঠকর্মীরা জানিয়েছেন।
মায়েদের বেশি সন্তান হচ্ছে
২০১২ সালের জনসংখ্যা নীতিতে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে টিএফআর ২ দশমিক ১ করা হবে। আরও বলা হয়েছিল, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ৭৫ শতাংশ করা হবে। এই দুটি লক্ষ্যের একটিও পূরণ হয়নি।
প্রজননক্ষম নারী সারা জীবনে (২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত) গড়ে যত সন্তানের জন্ম দে, তাকে বলা হয় মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর)। স্বাধীনতার সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের দিকে দেশে টিএফআর ছিল ৬-এর বেশি। অর্থাৎ মায়েরা গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন।
তৎকালীন সরকার এবং পরবর্তী সরকারগুলো টিএফআর কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিশেষ জোর দেয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি মানুষের দোরগোড়ায় পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। এতে সাফল্য আসে। টিএফআর কমতে থাকে। বাংলাদেশের যেসব সাফল্য বহির্বিশ্বে স্বীকৃত, তার একটি এই টিএফআর কমিয়ে আনতে পারার ঘটনা। গত শতকের আশির দশক থেকে টিএফআর দৃশ্যমানভাবে কমতে থাকে।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে টিএফআর কখনো বাড়তে দেখা যায়নি। হয় ক্রমাগত কমেছে, না হয় কয়েক বছর ধরে টিএফআর স্থির অবস্থায় ছিল। যেমন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির অবস্থায় ছিল। টিএফআর কেন কমছিল না, তা নিয়ে সমালোচনা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কি গ্রাম, কি শহর—সবখানেই জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, নদীনালা, জলাশয় দখল হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার প্রভাব ফেলছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। আবাসন, পরিবহনসহ সব খাতে সংকট বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড় চোখে পড়ে। দেশে শিশু অপুষ্টি বেশি, পাঁচ বছর কম বয়সী ২৪ শতাংশের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। বেকার মানুষের সংখ্যাও অনেক। প্রায় দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই পরিস্থিতিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সব ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উদ্যোগ হুমকিতে পড়বে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিগত অবস্থান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জনসংখ্যা কার্যক্রমে গভীর প্রভাব ফেলে। সর্বস্তরের কর্মকাণ্ডে শিথিলতা চলে আসে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এটা মনে করতে থাকেন যে সব কাজ হয়ে গেছে, আমাদের আর কিছু করার দরকার নেই। লম্বা সময় ধরে কার্যত সব কাজ স্থবির হয়ে আছে। বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। টিএফআর ৩ হলে আশ্চর্য হব না।’