ঘরে–বাইরে নারীদের ভয় কোথায়? যা দেখাচ্ছে জরিপ

ছবি: প্রথম আলো গ্রাফিকস

গত ২৭ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জুতা হাতে এক তরুণীর বাস কন্ডাক্টরের আচরণের প্রতিবাদ জানানোর ঘটনাটি বেশ আলোড়ন তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে ওই তরুণী হাফ ভাড়া দিলে বাসচালকের ওই সহকারী অশালীন মন্তব্য করেন। তখন জুতা হাতে প্রতিবাদ জানানোর পর হামলার শিকারও হয়েছিলেন তিনি।

সেই ঘটনার ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি ওই তরুণী। প্রায় দুই মাস পর গত রোববার যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও নারীর প্রতি সহিংসতা দেখলে তাঁর ওই দিনের ঘটনা মনে পড়ে যায়, বিষণ্ন হয়ে পড়েন তিনি।

আরেক নারী এই প্রতিবেদককে নিজের সংসারের অশান্তির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বিয়ের পর থেকে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তিনি। তাঁদের সংসারে ৫ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সম্প্রতি স্বামী তাঁকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছেন।

পারিবারিক সহিংসতায় গত ১৩ আগস্ট রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় মৃত্যু হয় সৈয়দা ফাহমিদা তাহসিন (২৫) নামের এক নারীর। তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে গেছেন স্বামী সিফাত আলী, অভিযোগ তাঁর পরিবারের।

উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ‘উইমেন ম্যানিফেস্টো’ শিরোনামে গবেষণার জন্য এ বছরের ২০ থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হয় এই জরিপ। এতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ২ হাজার ৫৮০ জন নারী অংশ নেন।

এ তো গেল সরাসরি আক্রমণ; তবে এখানেই শেষ নয়। সহিংসতার নতুন মাত্রা এখন দৃশ্যমান। তার শিকার টাঙ্গাইলের এক স্কুলছাত্রী। গত জানুয়ারি মাসে তার ডিপফেক পর্নোগ্রাফি তৈরি করে পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এলাকাতেও। এ কাজটি মেয়েটির এক সহপাঠি করেছিল বলে অভিযোগ। কিশোরীর মা কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, এটা যে ভুয়া ভিডিও তা সবাই বোঝে না। তাঁর মেয়ে ও তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

নিজের গণ্ডি থেকে শুরু করে খেলা, বিনোদন, উদ্যোক্তা ও রাজনীতি—সব ক্ষেত্রের নারীরাই এখন এমন ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত অনলাইনে কী ধরনের অশ্লীল বাক্যবাণের শিকার হচ্ছেন, জুলাই আন্দোলনে থাকা এক নারী গত মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।

এ ধরনের সহিংসতা সার্বিকভাবে নারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ কতটা বাড়িয়ে তুলেছে, তা উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের এক গবেষণায়। এ জন্য পরিচালিত জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ভাবনায় উঠে এসেছে গত বছরের গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাঁরা কোন ধরনের সহিংসতাকে কতটা সমস্যা বলে মনে করছেন।

সহিংসতা আর নিরাপত্তাহীনতার কথাই নারীদের ভাবনায় বেশি উঠে এসেছে। নারীরা সহিংসতার ভয়ে ভুগছেন।
অধ্যাপক তানিয়া হক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জরিপে অংশ নেওয়া ৯৪ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা গণপরিবহনে, ডিজিটাল জগৎ ও পারিবারিক বৃত্তে ঘটা সহিংসতাকে সমস্যা মনে করছেন। এর মধ্যে ৬৬ শতাংশের বেশি নারী একে ‘গুরুতর সমস্যা’ বলেই মনে করেন।

নারীরা জানিয়েছেন, সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিরাপত্তার অভাব ও পারিবারিক বাধা তাদের জন্য কতটা বাধার সৃষ্টি করছে। আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কী চান, তা–ও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের নেতৃত্বে ‘উইমেন ম্যানিফেস্টো (নারী ইশতেহার)’ শিরোনামে গবেষণাটির আরও দুই গবেষক হলেন একই বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ ও সহযোগী অধ্যাপক ইশরাত জাহান খান। এ বছরের ২০ থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে অংশ নেন ২ হাজার ৫৮০ জন নারী।

সহিংসতাই সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা বড় বাধা

‘আমরা আর ভয়ের মধ্যে বাস করতে চাই না। আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম এই ভয়ের মধ্যে আমাদের কন্যাসন্তানকে গড়ে তুলতে। ঘরে-বাইরে, স্কুলে, ডিজিটাল জগতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু একটি অপরাধ নয়, এটা রাষ্ট্রের গভীর নৈতিক ব্যর্থতা,’ নারীদের এই মত তুলে ধরা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩ শতাংশের বেশি নারী পারিবারিক সহিংসতাকে একটি সমস্যা মনে করার কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ৬১ শতাংশ এটাকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

গণপরিবহনে যৌন সহিংসতাকে সমস্যা বলে মনে করছেন জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশের বেশি নারী। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ একে বলেছেন গুরুতর সমস্যা।

ডিজিটাল জগতে সহিংসতাকে সমস্যা বলেছেন ৯২ শতাংশের বেশি নারী। এর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ এটিকে গুরুতর সমস্যা বলে মনে করছেন।

সমাজের মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে নারীদের ‘সবচেয়ে বড় বাহ্যিক বাধা বা ভয় কী?’ এমন প্রশ্নের জবাবে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মোটাদাগে চারটি বাধার কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮ শতাংশ বলেছেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব, দুর্নাম বা ভুক্তভোগী হওয়ার ভয়।

ছবি: প্রথম আলো গ্রাফিকস

পরিবার ও স্বামীর মাধ্যমে সমস্যা সৃষ্টি হওয়া ভয়ের কথা বলেছেন প্রায় ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের সরাসরি বিরোধিতা ও সমাজের লোকজন ও ধর্মীয় নেতাদের সমর্থনের অভাবের কথাও উঠে এসেছে।
অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, সহিংসতা আর নিরাপত্তাহীনতার কথাই নারীদের ভাবনায় বেশি উঠে এসেছে। নারীরা সহিংসতার ভয়ে ভুগছেন।
৫৯ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার বিষয়ে ছেলেদের সচেতন করতে সরকারের জরুরি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

‘আপনার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সরকার একটি উদ্যোগ নিলে সেটি কী হওয়া উচিত?’ এই প্রশ্নের জবাবে ৪২ শতাংশ বলেছেন, চাকরি, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া উচিত।

সংসদে ৪০% আসন চান নারীরা

রাজনৈতিক কাঠামোয় যে আরও শক্তিশালী অবস্থান চাইছেন নারীরা, তা উঠে এসেছে এই গবেষণায়। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৩ শতাংশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি দলে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে মত জানিয়েছেন। সংসদে নারীদের জন্য ৪০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন ৬১ শতাংশ নারী।

বর্তমানে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০টি, যা মোট আসনের ১৫ শতাংশ।
রাজনীতিতে নারীদের প্রবেশে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি? এমন প্রশ্নের জবাবে জরিপে অংশ নেওয়া ৫৩ শতাংশ নারীবান্ধব পরিবেশের অভাবের কথা বলেছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপের অভাব, আর্থিক সহায়তার অভাব ও বাধ্যতামূলক কোটা না থাকার কথাও উঠে এসেছে।

কোনো রাজনৈতিক দলের নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে প্রতিশ্রুতি আপনার ভোটকে কতটা প্রভাবিত করবে? এর জবাবে প্রায় ৭৭ শতাংশ নারী প্রভাবিত হবে বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ বলেছেন, এটাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই কোনো দলকে তাঁর ভোট দেওয়ার প্রধান মানদণ্ড হবে।

এ ক্ষেত্রে নারীদের মনোভাব তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা ভোট দেব, কিন্তু মনে রাখব। আমরা মনে রাখব কে আমাদের কথা শুনেছে, কে শোনেনি।’

অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক, তাই নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন অর্ধেক হিস্যা চাইছেন। নারীরা সমানভাবে নেতৃত্বের স্থানে থাকতে চান, মর্যাদা চান। নারীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীদের এই প্রত্যাশার কথা মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।’

ইশতেহারে ১২ বিষয়ে অঙ্গীকার প্রত্যাশা

গবেষণা প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে ১২টি বিষয়ে অঙ্গীকার থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে—নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব, সাইবার নিরাপত্তা, চলাফেরার নিরাপত্তা, আইনে সমান অধিকার, জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যক্রম, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও বিনা মূল্যের গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি, প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও সাংস্কৃতিক বাধা দূর করা, প্রান্তিক নারীরদের অন্তর্ভুক্তি, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাঠামোয় সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির ক্ষেত্রে নারীর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।

অধ্যাপক শাইখ ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, এই গবেষণাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী নিজের জন্য কোন কোন বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে, তা তুলে আনা এবং সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর আমলে দেওয়া। যে দলগুলো সরকার গঠন করবে, সে দলগুলো বুঝতে পারবে নারীরা কী চাইছে।

শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, ‘ধারণা করা হতো যে নারীরা পুরুষদের প্রতিপক্ষ ভাবছেন। খুব আশ্চর্যজনকভাবে জরিপে উঠে এসেছে নারীরা চান, পুরুষদের জেন্ডার সংবেদনশীলতা গড়ে তুলতে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এতে করে সমস্যার সমাধান সহজ হবে।’