চাল রপ্তানিতে ভারতের নতুন শর্ত, তবে প্রভাব পড়ছে না বাংলাদেশের বাজারে
চালের মজুত ঠিক রাখতে বাংলাদেশ আমদানির একটি বড় অংশ করে ভারত থেকে। সেই ভারত রপ্তানিতে দিয়েছে নতুন শর্ত। তবে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বাংলাদেশের বাজারে।
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমে এসেছে, ভারতের বিকল্প উৎসও আছে। ফলে চালের বাজার স্থিতিশীলই থাকবে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ভারতের নতুন শর্তে চাল আমদানিতে কোনো অসুবিধার মুখে পড়ছেন না তাঁরা।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাসমতী ছাড়া অন্য চাল রপ্তানিতে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এপিইডিএ) নিবন্ধন নিতে রপ্তানিকারকদের নতুন শর্ত বেঁধে দেয় ভারত। দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তর (ডিজিএফটি) এ–সংক্রান্ত আদেশ জারি করে এ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে। শর্ত অনুযায়ী, চাল (নন–বাসমতী) কেবল এপিডিএর সঙ্গে চুক্তি নিবন্ধনের পরই রপ্তানি করা যাবে।
বাংলাদেশ ভারত থেকে মূলত নন–বাসমতী বা সাধারণ চালই আমদানি করে। গত অর্থবছরে ভারত থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। এই অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা প্রায় একই।
নতুন শর্ত অনুযায়ী নিবন্ধন নেওয়ার যে বিষয়, তাতে আমদানি বিঘ্নিত হবে না। আমরা যাদের কাছ থেকে চাল কিনি, তারা এ নিবন্ধন এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ লাখ টন। এর মধ্যে আতপ চাল আমদানি হবে ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। বাকিটা সেদ্ধ চাল।
ভারতের নতুন শর্তে সরকারি চাল আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন শর্ত অনুযায়ী নিবন্ধন নেওয়ার যে বিষয়, তাতে আমদানি বিঘ্নিত হবে না। আমরা যাদের কাছ থেকে চাল কিনি, তারা এ নিবন্ধন এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।’
দেশের অন্যতম শীর্ষ চাল আমদানিকারক চিত্ত মজুমদারও প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের নতুন শর্তে তাঁরা চাল আমদানিতে কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন না। তাই চালের বাজারেও এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব পড়েনি।
গতকাল বুধবার ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় ভারত থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ মাসের ১৫ তারিখে আরও ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির উন্মুক্ত দরপত্র হবে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ চাল আমদানিকারক চিত্ত মজুমদারও প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের নতুন শর্তে তাঁরা চাল আমদানিতে কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন না। তাই চালের বাজারেও এ সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাব পড়েনি।
গত অর্থবছরে সরকার বেসরকারি পর্যায়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল। তবে কী পরিমাণ আমদানি হয়েছে, সে তথ্য দিতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম কম। গত বছর প্রতি টন চালের দাম ছিল ৪৭৭ মার্কিন ডলার। এবার তা ৩৫৯ ডলারে নেমে এসেছে। এবার গতবারের তুলনায় প্রতি টন চাল ১১৮ ডলার কমে আমদানি করা যাচ্ছে।
মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে চালের দাম কমে গেছে জানিয়ে মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে এক লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছি। ভিয়েতনামের সঙ্গেও আগামী মাসে সমপরিমাণ চাল আমদানির চুক্তি হবে।’
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার মিয়ানমার প্রতি টন চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৭৬ মার্কিন ডলার, যা আগের বছর ছিল ৫১৫ ডলার। ভিয়েতনামের চালের দামও এটার কাছাকাছি।
মোটা চাল ৬৫ টাকায়, আর মিনিকেট ৮০ টাকায় বিক্রি করছি। চালের দাম আগের মতোই আছে।ফার্মগেট এলাকার তেজতুরী বাজারের ভাই ভাই স্টোরের মালিক মো. জুয়েল
দেশে এখন চালের মজুতও পর্যাপ্ত থাকার কথা বলছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে। যেখানে ১২ লাখ মেট্রিক টন চালের মজুতকে নিরাপদ মজুত (সিকিউরড স্টক) হিসেবে ধরা হয়। ১৫ নভেম্বরের পর থেকে আমন সংগ্রহ শুরু হলে মজুত আরও বাড়বে।
ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে চালের বাজার স্থিতিশীলই দেখা গেছে। কারওয়ান বাজারের হাজী রাইস এজেন্সির মালিক হাজী রইছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাস ধরে চালের দাম একই রয়েছে। দাম বাড়েনি। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে। আর সরু চাল প্রতি কেজি মানভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মগেট এলাকার তেজতুরী বাজারের ভাই ভাই স্টোরের মালিক মো. জুয়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোটা চাল ৬৫ টাকায়, আর মিনিকেট ৮০ টাকায় বিক্রি করছি। চালের দাম আগের মতোই আছে।’
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক মূল্য তালিকায় দেখানো হচ্ছে, প্রতি কেজি মোটা চালের দাম সর্বনিম্ন ৫৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা। সরু চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে।
অবশ্য এক মাস বা এক বছরের চিত্র দেখে চালের বাজারের পরিস্থিতি আঁচ করা কঠিন। কারণ, ২০২০ সালে কোভিড মহামারি শুরুর পর থেকে চালের দাম ধাপে ধাপে বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে, ওই বছর জানুয়ারি মাসে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। তখন মাঝারি চাল ৪০ থেকে ৫০ এবং সরু চাল ৪৫ থেকে ৬০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। মাঝারি চালের কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, সরু চালের কেজি ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চে চাল ও গমের মজুত ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার টনের কিছু বেশি। ২০২৫ সালের মার্চে তা প্রায় ৯৪ হাজার টন কমে ১৫ লাখ ১৭ হাজার টনে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের মার্চে চালের মজুত ছিল ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টনের কিছু বেশি। ২০২৫ মার্চে সেটি দাঁড়ায় ১০ লাখ ৮৩ হাজার টনে। এখন চালের মজুত আছে ১৫ লাখ ৮০ হাজার টন।
২০২৫ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত সেদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ করা হয় ৫ লাখ ১৩ হাজার টন, যা লক্ষ্যের ৭৯ শতাংশ। ২ মার্চ পর্যন্ত ধান সংগ্রহ ছিল ২৬ হাজার ৫১১ টন, যা লক্ষ্যের মাত্র ৭ দশমিক ৫৭। অন্যদিকে তখন আমদানিও তেমন বাড়ানো যায়নি।
২০২৪ সালে বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট বোরো সংগ্রহের চুক্তি শেষ হয়ে যায়। মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো হলে দুই লাখ টন চাল বাড়তি সংগ্রহ করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
২০২৪ সালে আমন সংগ্রহও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ টন ধান, সাড়ে পাঁচ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং এক লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। ২০২৫ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত সেদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ করা হয় ৫ লাখ ১৩ হাজার টন, যা লক্ষ্যের ৭৯ শতাংশ। ২ মার্চ পর্যন্ত ধান সংগ্রহ ছিল ২৬ হাজার ৫১১ টন, যা লক্ষ্যের মাত্র ৭ দশমিক ৫৭। অন্যদিকে তখন আমদানিও তেমন বাড়ানো যায়নি। ২০২৪ সালের আগস্টে বন্যায় আমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়।