ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধান
ফেসবুকে আওয়ামী লীগ সমর্থক এক হাজার অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত, বিপক্ষে গেলেই রিভিউ আক্রমণ
দেশের নতুন একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা তাঁর পক্ষে যায়নি। এরপরই সংবাদমাধ্যমটির ফেসবুক পেজে শুরু হয় নেতিবাচক ‘রিভিউ’ (মূল্যায়ন) দেওয়া।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এভাবে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে বিভিন্ন ফেসবুক পেজের ‘রেটিং’ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আক্রমণের শিকার হচ্ছে সংবাদমাধ্যম, বিশ্লেষক, রাজনৈতিক দল, সরকারি সংস্থা, জনপ্রিয় ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ।
এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এক হাজারের বেশি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। অ্যাকাউন্টগুলো বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব নিশ্চিত হয়েছে, অ্যাকাউন্টগুলো কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এভাবে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে বিভিন্ন ফেসবুক পেজের ‘রেটিং’ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ফেসবুকে কোনো প্রতিষ্ঠানের পেজে ব্যবহারকারীরা রিভিউ দিতে পারেন। এতে বোঝা যায়, ব্যবহারকারী সেই পেজকে কতটা রিকমেন্ড করছেন, অর্থাৎ ওই মাধ্যমের সংবাদ, ব্যক্তির মতামত, প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন। সম্মিলিত আক্রমণের ফলে প্রতিষ্ঠানের রেটিং (মানুষের মতামতভিত্তিক মান) কমে যায়।
সম্মিলিত ও ক্রমাগত আক্রমণকে রাজনৈতিক মত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বলে উল্লেখ করেন ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেটিং কমে গেলে নতুন ব্যবহারকারীরা অনেক সময় ওই পেজের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাঁরা বিভ্রান্ত হন। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিষয়গুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
যেভাবে শনাক্ত
ডিসমিসল্যাব সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের ১ হাজার ১১৮টি পেজের ৬২ হাজার ৫২৯টি রিভিউ পোস্ট বিশ্লেষণ করেছে। এর মাধ্যমে ১ হাজার ১৯টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়। দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই চক্র অন্তত ৭২১টি পেজকে লক্ষ্যবস্তু করে। পেজগুলোতে তারা ‘ভুয়া তথ্য ছড়ানো’, ‘সন্ত্রাসবাদে জড়িত’ অথবা ‘সামাজিক অবক্ষয়ের’র অভিযোগ তুলে সম্মিলিত আক্রমণ করেছে।
ডিসমিসল্যাব নিজেরাই এর শিকার। তারা সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারাকে অনলাইন হয়রানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরপরই তাদের পেজে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্যান্য অ্যাকাউন্ট থেকে একই লেখা পুনরাবৃত্তি করা হতে থাকে। ২ ঘণ্টায় ৪৮টি নেতিবাচক রিভিউ পড়ে, যেখানে ডিসমিসল্যাবকে অপপ্রচারকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এসব রিভিউ থেকে একই রকম ২৩টি রিভিউ চিহ্নিত করে ডিসমিসল্যাব। পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানে তারা দেখে, ওই একই রিভিউ ১ হাজার ৪৭৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে আরও ৩১৫টি পেজে।
সর্বশেষ অনুসন্ধানে চিহ্নিত ১ হাজার ১৯টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের তথ্য বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখেছে, চক্রটি ১৩ হাজারের বেশি রিভিউ পোস্ট করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশই আওয়ামী লীগপন্থী বার্তা বহন করে।
রেটিং কমে গেলে নতুন ব্যবহারকারীরা অনেক সময় ওই পেজের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাঁরা বিভ্রান্ত হন। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিষয়গুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী
কারা আক্রান্ত
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নেটওয়ার্কটি মূলত সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেসবুক পেজে বেশি আক্রমণ চালিয়েছে। বাদ যায়নি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অনলাইন বই বিক্রয় পেজ এবং প্রকাশনা সংস্থাও। এমনকি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও পাকিস্তান হাইকমিশনের পেজও আক্রমণের শিকার হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দৃক তাদের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ছবি পোস্ট করার পর তাদের ফেসবুক পেজ আক্রমণের মুখে পড়ে। বিএনপি মিডিয়া সেল, জামায়াতে ইসলামী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের পেজ আক্রমণের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) ববি হাজ্জাজ, গণ অধিকার পরিষদের রাশেদ খান, ফারুক হাসান, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। লেখক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন, মোস্তফা ফিরোজ, বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমানসহ অনেকে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন মায়ের ডাকও আক্রমণের শিকার হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দৃক তাদের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ছবি পোস্ট করার পর তাদের ফেসবুক পেজ আক্রমণের মুখে পড়ে।
ইতিবাচক রিভিউও দেয় চক্রটি
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ওই ১ হাজার ১৯টি অ্যাকাউন্ট বহু আওয়ামী লীগ–সমর্থক পেজ, ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমের পেজ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক রাজনীতিকের ফেসবুক প্রোফাইলে ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। কোনো কোনো অ্যাকাউন্ট কলকাতাভিত্তিক এবিপি আনন্দ ও রিপাবলিক বাংলার পেজে ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে। জি ২৪ ঘণ্টার পেজেও বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছে চক্রটিতে থাকা অ্যাকাউন্টগুলো।
এই চক্রের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি চক্রও খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। তবে এরা ছোট ও কম সমন্বিত বলে উল্লেখ করেছে ডিসমিসল্যাব। এদের প্রকৃত পরিসর জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন মনে করে তারা।
সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের ভুয়া রিভিউর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার ওপর চাপ বাড়ানোর পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। তিনি বলেন, এ ধরনের মেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যতক্ষণে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ শুরু করে, ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো এমন ঘটনায় মেটাকে চাপে রাখে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে মেটাকে জানানো হয়। বাংলাদেশ থেকেও এমন ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই চক্রের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি চক্রও খুঁজে পেয়েছে ডিসমিসল্যাব। তবে এরা ছোট ও কম সমন্বিত বলে উল্লেখ করেছে ডিসমিসল্যাব। এদের প্রকৃত পরিসর জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন মনে করে তারা।