সরকারি অনুদান পেলেও হিসাব দেয় না এই প্রতিষ্ঠান

  • ২০০৬ সালে সিভিল সার্ভিস কলেজ নামে প্রতিষ্ঠা, পরে নাম বদল।

  • সুশাসনের শিক্ষা দেওয়া হলেও জবাবদিহি নেই।

  • এ পর্যন্ত অনুদান পেয়েছে ১৮০ কোটি টাকা।

বিআইজিএম ভবন

প্রতিষ্ঠানটি সরকারি নয়, স্বায়ত্তশাসিতও নয়। কিন্তু বছরের পর বছর সরকারের কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা অনুদান পাচ্ছে। বিপুল এ অর্থের হিসাবও দেওয়া হয় না।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে মূলত অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মাধ্যমে। এটা তাঁদের ‘পুনর্বাসনকেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সরকারকেই কোনো হিসাব দেন না তাঁরা।

প্রতিষ্ঠানটির নাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম)। এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিআইজিএম সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত একটি প্রতিষ্ঠান, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের কাছে তাঁদের কোনো জবাবদিহি নেই।

২০০৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে সিভিল সার্ভিস কলেজ, ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটির নাম বদলে করা হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানে সুশাসন, প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে মাস্টার্সসহ স্বল্পমেয়াদি কোর্স করানো হয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমও পরিচালনা করে তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিআইজিএমে সুশাসনের শিক্ষা দেওয়া হলেও নিজেরাই জবাবদিহি মানে না।

সরকারের টাকা, সরকারই হিসাব পায় না

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বিআইজিএম প্রতিবছর গড়ে ১০ কোটি টাকা করে অনুদান পাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের দেওয়া হয়েছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পেয়েছে তারা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অনুদান পেয়েছে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। তবে বিপুল এ অর্থ খরচের ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিস্তারিত তথ্য জানতে পারছে না।

সরকারি না হলেও সরকার থেকে প্রতিবছর ১০ কোটি টাকা করে পাচ্ছে। যেন সাবেক আমলাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র।

মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কোন আইন বা নীতিমালার আলোকে বিআইজিএম সরকারি কোষাগার থেকে টাকা নিচ্ছে, তা জানতে চেয়ে গত বছরের ৩০ অক্টোবর চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিআইজিএম এখনো এর জবাব দেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

ওই চিঠির পর বিআইজিএম খরচের একটি খসড়া তালিকায় বলেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাওয়া টাকার মধ্য থেকে কর্মীদের বেতন বাবদ ৮ কোটি, গবেষণায় ১ কোটি ২০ লাখ, কেনাকাটায় ৬০ লাখ, ভবন সংস্কারে ১৮ লাখ, মনিহারি খাতে ১৩ লাখ টাকা খরচ করা হবে।

এ পটভূমিতে গত বছরের ২৪ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গবেষণা ও সংস্কার অনুবিভাগ থেকে পৃথক চিঠি দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। চিঠিতে বলা হয়, বিআইজিএমের পরিচালনা বোর্ডে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা নেই। এতে প্রশ্ন তোলা হয়, ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সহায়তা পদ্ধতি টেকসই কি না। বিআইজিএম সরকারি বেতনকাঠামো মানে না উল্লেখ করে চিঠিতে এ পদ্ধতিকে ‘শোষণমূলক শাসনব্যবস্থা’ আখ্যা দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে জানতে সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইজিএমের পরিচালকের কক্ষে যান এই প্রতিবেদক। সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক ৯ বছর ধরে পরিচালক পদে আছেন। অনুদান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্ন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞেস করুন। এই টাকা গ্র্যান্ট ইন এইড। যারা দেয়, তারা জানে।’ তিনি তাঁর সম্পর্কে ‘যা লেখার লিখতে পারেন’ মন্তব্য করে এ প্রতিবেদককে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।

পরে অনুদানের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের (সিপিটি) প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব এ এন এম মঈনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ দপ্তরে তিনি নতুন এসেছেন। অনুদানের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

সাবেক কর্মকর্তাদের ‘পুনর্বাসনকেন্দ্র’

বিআইজিএমের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ১৫ সদস্যের। এখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অর্থসচিব আছেন। আছেন কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। বিআইজিএমের পরিচালক নিয়োগের পদ্ধতি ও সময়সীমা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকেই প্রশ্ন উঠেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিআইজিএমের পরিচালক ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার নিয়োগ পদ্ধতি ও শর্তের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে চিঠি দিলেও বিআইজিএম সহযোগিতা করছে না।

চিঠির সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিআইজিএম প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তাদের ‘পুনর্বাসনকেন্দ্র’ হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার শীর্ষ পদগুলোর বেশির ভাগে রয়েছেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সাবেক আমলাদের মধ্যে রয়েছেন সুলতান আহমেদ, গোলাম ফারুক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আব্দুর রহিম খান, মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার ও কৃষ্ণা গায়েন। এ ছাড়া অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিআইজিএমে নিয়মিত ক্লাস নেন। তাঁরা মোটা অঙ্কের সম্মানী পান বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি চাকরিজীবীদের অল্প খরচে ছয়টি বিষয়ে মাস্টার্স করানো হয়। আরও কয়েকটি কোর্স করানো হয় নামমাত্র খরচে। বিআইজিএমে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, এখানে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি স্পষ্ট।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জাইকার টাকায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিআইজিএম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প থেকেও আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ১২ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে টাকা নিলে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এ টাকা জনগণের। যাদের কাছ থেকে অনুদান নিচ্ছে, তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বিআইজিএমকে। যদি না করে, সেটি দুঃখজনক।