ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আদালত হলো শেষ আশ্রয়স্থল। তাই একজন বিচারকের সততা ও নিরপেক্ষতা যেমন অপরিহার্য, তেমনি বিচারিক কাজে তার দক্ষতা ও যোগ্যতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিচার অঙ্গনে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ কিংবা মামলা নিষ্পত্তি হতে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের মতো বিষয়গুলো আদালত বা বিচারকের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়। এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল নিম্ন আদালতের বিচারক ও আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। মো. জালাল উদ্দিন মিয়া ও অন্যান্য বনাম আলহাজ আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য মামলায় ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি রায় ঘোষণা করেছিলেন ওই বিচারপতি। ১৬ জুন প্রকাশিত ৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি বিচারক-আইনজীবীদের জন্য ১৫ দফা পরামর্শ ও দুটি নির্দেশনা প্রদান করেন।
১৫ দফা পরামর্শ
১. বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, আইনজীবী, সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি, ভারত’–এর আদলে সুবিধাজনক ও নিরিবিলি পরিবেশে এক হাজার হেক্টর জায়গার ওপর ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা।
২. বিচারকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স ছয় মাসে উন্নীত করা এবং প্রশিক্ষণকালে তাদের মনোজাগতিক বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় আবশ্যিকভাবে একজন মনোবিজ্ঞানীকে ভাইভা বোর্ডে সদস্য রাখা।
৪. বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পরই নবনিযুক্ত বিচারকদের বিচারিক দায়িত্ব প্রদান করা।
৫. সব পর্যায়ের বিচারকদের জন্য প্রতিবছর অন্তত দুবার ১৫ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬. বিচারকদের দেশের বাইরে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সে ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জুডিশিয়াল ট্রেনিং সেন্টার/ ইনস্টিটিউট/একাডেমির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করা।
৭. দেওয়ানি কার্যবিধি, ‘সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’ এবং ‘ম্যানুয়াল অব প্র্যাকটিস ইনস্ট্রাকশনস ফর দ্য কন্ডাক্ট অব দ্য সিভিল কেসেস’–এর ব্যাপক সংশোধন যুগোপযোগীকরণ ও উন্নতকরণ।
৮. যুক্তরাজ্যের আদলে মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও হেতুবিহীন দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ/ খরচ প্রদান সংক্রান্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা।
৯. দেওয়ানি বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত সেরেস্তাদার পদটিকে নন-গেজেটেড প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা। ওই পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচার বিভাগীয় সহায়ক কর্মচারীদের পদ-পদবির পরিবর্তন করা।
১০. অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে সিভিল মামলায় (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের মতো) জবানবন্দি গ্রহণের বিধান করা।
১১. দেওয়ানি মামলার আপস-নিষ্পত্তি এবং জারি মামলার ক্ষেত্রে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে আরও সম্পৃক্ত করা এবং তার এখতিয়ার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সে জন্য আইন ও বিধি সংশোধন করা।
১২. প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নিয়োগ, বিচারকের নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধি করা।
১৩. অনলাইন ফাইলিং এবং অনলাইন কজ লিস্টের মাধ্যমে মামলা ব্যবস্থাপনা করা।
১৪. একজন আইনজীবী তথা অ্যাডভোকেট আদালতের অফিসার। দেশ ও সমাজের প্রতি অ্যাডভোকেটদের কর্তব্য এবং দায়বদ্ধতা অপরিসীম। কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা, আইনগত অধিকারবিহীন, অযৌক্তিক ও অন্যকে হয়রানিমূলক মোকদ্দমা দায়েরে সহযোগিতা না করা।
১৫. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ বাংলাদেশের সব আইনজীবী সমিতি এ ব্যাপারে সভা ও সেমিনার আয়োজন করে বেআইনি ও আইনগত অধিকারবিহীন অহেতুক মিথ্যা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা পরিহার করতে নিজ নিজ সমিতির আইনজীবীদের সচেতন করলে দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন পালিত হবে তেমনি প্রয়োজনীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিচারিক সময় ব্যয় করা যাবে এবং মামলা জট হ্রাস পাবে।
বিচারপতি আশরাফুল কামাল রায়ে বলেন, উপরোল্লিখিত পরামর্শগুলো দ্রুত কার্যকর করলে বিচারব্যবস্থার ভয়াবহ মামলা জট থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসা যাবে। আইন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবে বলেও আদালতের রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়।
দুই দফা নির্দেশনা
১. অধস্তন সব আদালতের সেরেস্তাদারেরা ‘সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’–এর নিয়ম ৫৫ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। সেরেস্তাদারেরা তা সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, সেটি সংশ্লিষ্ট সব সেরেস্তাদারদের নিয়ন্ত্রণকারী বিচারক দেখভাল করবেন।
২. ‘ম্যানুয়াল অব প্র্যাকটিস ইনস্ট্রাকশনস ফর দ্য কন্ডাক্ট অব দ্য সিভিল কেসেস’ এবং এই রায়ের গর্ভে বর্ণিত পদ্ধতিতে সব দেওয়ানি আদালতের বিচারকেরা বিচারকার্য পরিচালনা করবেন।
উপরোক্ত ১৫টি দফার মধ্যে প্রথম ৬টি দফায় বিচারক-আইনজীবীদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের মতো জুডিশিয়াল একাডেমি তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিচারপতি আশরাফুল কামাল। কিন্তু শুধু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারতে বিচারক নিয়োগ পেতে হলে বার কাউন্সিল থেকে সনদ পাওয়ার পর আদালতে ছয় মাস আইনজীবী হিসেবে কাজ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম কোনো বিধিবিধান নেই। বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থায় যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে চার বছর মেয়াদি অনার্স শেষ করেই বিচারক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এর ফলে আদালত সম্পর্কে তেমন কোনো প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোনো ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেত পারেন। বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর যে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, সেটা বিচারকাজ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয় বলে অনেকে মনে করেন।
১৫ দফা পরামর্শে বিচারকদের পাশাপাশি আইনজীবীদেরও পেশাগত মানোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আইনজীবী হিসেবে সনদ দেওয়ার পর বার কাউন্সিল তাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করত। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণের বিষয়টি এখন অনিয়মিত হয়ে গেছে। এ প্রশিক্ষণ পুনরায় চালু না হলে নবীন আইনজীবীরা অনেক কিছু শেখা ও জানা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জনে তাঁরা পিছিয়ে থাকবেন।
৭ থেকে ১৫ দফার মধ্যে দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার সংস্কার, বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো এবং বিচারব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার তথা ই-জুডিশিয়ারি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার বহন করছে। তাই শুধু দেওয়ানি নয়, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিচারকের সংখ্যা খুব কম—এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আদালতগুলো অনেক দিন ধরেই মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। এই মামলাজট কমাতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতেই হবে। বহুদিন ধরে ‘ই-জুডিশিয়ারি’ নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা গেলেও এটা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং ‘ই-জুডিশিয়ারি’ দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
১৫ দফা পরামর্শে বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলা হলেও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। অনেক দেশেই বিকল্প পন্থায় মামলা নিষ্পত্তির গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা এখনো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে দায়ী আইনগত ত্রুটি ও কাঠামোগত দুর্বলতা। এগুলো দূর করতে পারলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে আদালত ও বিচারকেরা যে বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করছেন, সংশ্লিষ্ট সবারই সে বিষয়ে কমবেশি ধারণা আছে। এ রকম অবস্থায় বিচারপতি আশরাফুল কামাল যে পরামর্শগুলো দিয়েছেন, সেগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কিছুটা হলেও বাড়বে।
কাইয়ূম আহমেদ আইনজীবী