২৩ বছর ধরে বিনা মূল্যে গণশৌচাগার সেবা দেন তিনি

আরিফ বেপারী। নিজের মার্কেটের নিচতলায় তিনি তিনটি শৌচাগার তৈরি করে তা সবার জন্য বিনা মূল্যে ব্যবহারের সুযোগ করে দেন
ছবি: জহির জয়ের সৌজন্যে

সাইনবোর্ডে লেখা ‘ফ্রি পাবলিক টয়লেট’। নিচে লেখা খাওয়ার পানি, গোসল ও অজুখানার সুব্যবস্থা আছে। আর আছে মো. আরিফ বেপারীর নাম ও মুঠোফোন নম্বর।

২৪ জুন রাতে তোলা এ সাইনবোর্ডের একটি ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন রাজধানীর উত্তরার বায়িং হাউস ক্যান্টন ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির জয়। সেখানে তিনি ‘পোস্টটি মোটেই হাসির নয়’ উল্লেখ করে লেখেন, একজন অভুক্তকে খাবার দেওয়ার চেয়েও এটা বড় সেবা। খিদে লাগলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা যায়, কিন্তু এ অবস্থায় অপেক্ষা করা সবার জন্যই কঠিন। পথের মধ্যে সমস্যায় পড়া মানুষই বলতে পারবে, এটা কত বড় উপকার।

এই পোস্টে আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৭২ হাজারের বেশি লাইকসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মানুষ। প্রায় দুই হাজার মানুষ পোস্টটি শেয়ার করেছেন। মন্তব্যে বেশির ভাগই মো. আরিফ বেপারীর এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

অন্যদিকে বিনা মূল্যে গণশৌচাগারের উদ্যোক্তা আরিফ বেপারী ফেসবুকের পোস্টের বিষয়ে কিছুই জানেন না। কিন্তু গত কয় দিনে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে আসা অসংখ্য ফোন ধরতে ধরতে তাঁর প্রায় পাগল হওয়ার দশা। তাই একসময় ফোন ধরাই প্রায় বাদ দেন। এই প্রতিবেদক তাঁকে অন্তত ১৫ বার ফোন দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ধরেননি। আজ শুক্রবার জহির জয় নিজেই যান আরিফ ব্যাপারীর বাড়িতে। গণশৌচাগারেও যান তিনি। জহিরের মাধ্যমেই আজ আরিফ বেপারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

শৌচাগারের সামনে ঝোলানো রয়েছে সাইনবোর্ড
ছবি: জহির জয়ের সৌজন্যে

আশুলিয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে আরিফ ব্যাপারীর নিজের মার্কেট আছে। এটির নাম আবদুল আজিজ মার্কেট। সেই মার্কেটের নিচতলায় তিনি তিনটি শৌচাগার তৈরি করে তা সবার জন্য বিনা মূল্যে ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। রয়েছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও পুরুষদের গোসল করার আলাদা স্থান। এই মার্কেটের কাছেই তাঁর নিজের বাড়ি।

আরিফ বেপারী জানালেন, ২৩ বছর ধরেই এখানে এ সেবা দিচ্ছেন। তবে এর আগে মানুষের কাছ থেকে এত ফোন পাননি। কেননা আগের সাইনবোর্ডে কোনো মুঠোফোন নম্বর দেওয়া ছিল না। ওই সাইনবোর্ড নষ্ট হওয়ার পর নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হয়। যিনি সাইনবোর্ড লিখেছেন, তিনিই অতি উৎসাহী হয়ে ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুকের পোস্টের বিষয়টিও তাঁর জানা ছিল না।

আরিফ বেপারী বলেন, ‘মানুষ টয়লেটে যাইব, এইখানে আমার নম্বর দেওয়ার তো কিছু নাই। আগে ছিলও না। এখন বরিশাল আর সিলেট নাই, বিদেশ নাই, মানুষ খালি ফোন করতাছে। এটা ভালো কাজ হইছে বলতেছে। কত টেলিভিশনের সাংবাদিক যে আসতেছে, তার তো কোনো হিসাব নাই।’

আমি যখন টয়লেট পরিষ্কার করি, তখন কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলে না। এমনকি টয়লেটে আসা মানুষও আমাকে কটু কথা বলে ভালো করে পরিষ্কার করার উপদেশ দেন। অথচ মানুষই নোংরা করে রেখে যায়।
আরিফ বেপারী

এত বছর আগে কেন এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানতে চাইলে আরিফ বেপারী বললেন, এর পেছনে বিরাট ইতিহাস আছে। জানালেন, তিনি বিদেশে গাড়িচালক ও বাগানের কাজ করেছেন। টুকটাক ব্যবসাও করেছেন। ওই সব দেশে গণশৌচাগারের বিষয়টি দেখেছেন। ২০০১ সালে দেশে ফেরার পর ব্যবসার কাজে রাজধানীর গুলিস্তানে গিয়েছিলেন। প্রস্রাবের চাপ পেলেও কোথাও শৌচাগার খুঁজে পাচ্ছিলেন না। একেকজন একেক দিকে দেখাতে থাকেন। এদিকে প্রচণ্ড চাপে তখন তাঁর অবস্থা কাহিল। তারপর বহু কষ্ট করে সেদিন তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। এর বাইরে মানুষকে যেখানে–সেখানে প্রস্রাব করতে দেখতেন, এটিও ভালো লাগত না তাঁর। তখন নিজের বাড়ির কাছেই মার্কেটের নিচতলায় বিনা মূল্যের গণশৌচাগার তৈরি করেন। সেখানে সাবান, পানিসহ যা যা লাগে, সবই দেওয়া আছে।

আরিফ বেপারী জানালেন, এ নিয়ে অনেকের কাছ অনেক বাজে কথাও শুনতে হয়েছে ও এখনো হচ্ছে। তিনি নিজে মানুষের নোংরা করে রেখে যাওয়া শৌচাগার পরিষ্কার করেন, তা কেউ মানতে পারেন না। তবে কাজটা তিনি মনের আনন্দের জন্যই করেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন টয়লেট পরিষ্কার করি, তখন কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলে না। এমনকি টয়লেটে আসা মানুষও আমাকে কটু কথা বলে ভালো করে পরিষ্কার করার উপদেশ দেন। অথচ মানুষই নোংরা করে রেখে যায়।’ দিনে ৩০০ জনের মতো মানুষ এই গণশৌচাগার ব্যবহার করেন বলে জানালেন আরিফ।

এখন পর্যন্ত শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন, তাই শৌচাগার পরিষ্কারের জন্য আলাদা কোনো মানুষ রাখেননি। আর তিনি যে দরদ দিয়ে কাজটা করেন, তা অন্য মানুষ না–ও করতে পারেন বলে জানালেন আরিফ বেপারী।

গণশৌচাগারের সামনে আরিফ ব্যাপারীর সঙ্গে ব্যবসায়ী জহির জয়
ছবি: জহির জয়ের সৌজন্যে

জহির জয় আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার ব্যবসার কাজে গিয়ে সাইনবোর্ডটি দেখে ভালো লাগায় ছবি তুলে তা পোস্ট করেছিলেন। তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি, এতে মানুষের এত সাড়া পাওয়া যাবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন,‘টয়লেটের অবস্থা আহামরি ভালো বলার উপায় নেই। তবে এ এলাকায় পাবলিক টয়লেট না থাকায় এখানে মানুষের প্রচুর চাপ থাকে। কাছেই বাসস্ট্যান্ড, বাসের চালক, সহকারী, যাত্রী, মার্কেটে আসা মানুষ—সবাই এ টয়লেট ব্যবহার করেন।’

গণশৌচাগার তিনটির অবস্থা এখন অনেকটাই শোচনীয়। নতুন সড়ক হওয়ায় শৌচাগারের মার্কেটের জায়গাটি নিচু হয়ে গেছে। জায়গাটি উঁচু করা ও শৌচাগারটি মেরামতের কাজ শুরু হবে বলে জানালেন আরিফ ব্যাপারী।

জহির জয় বললেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, আরিফ বেপারীর এ উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে মানুষকে বিনা মূল্যে শৌচাগার ব্যবহারের মতো একটি সেবা দেওয়ার বিষয়টি তো সহজ কোনো কাজ নয়। পরিশ্রম এবং নিজের টাকা খরচ করে তিনি কাজটি করছেন। তিনি এ নিয়ে কোনো প্রচারও চাননি কখনো। ফেসবুকে পোস্টটি দেওয়ার পরই মূলত তাঁর কাজটির কথা মানুষ জানতে পারছে।’