গ্যাস–সংকট: ধুঁকছে শিল্প, সংকট আবাসিকেও

শিল্পে উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে বলে দাবি মালিকদের। দিনের বড় সময় গ্যাস না থাকায় বাসাবাড়িতে ঠিকঠাক চুলা জ্বলছে না।

শীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তাই এ খাতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ—দুই-ই কমেছে। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমায় অন্যান্য খাতে গ্যাস সরবরাহে ভাটা কাটেনি। দেশেও গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এতে করে শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকেরা গ্যাস-সংকটে ভুগছেন। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকেরা।

বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দৈনিক ১১০ থেকে ১১২ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে এ খাতে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ কোটি ঘনফুট। তবে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। সংকটের সময় সাধারণত অধিকাংশ সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়। বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এখন সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে দিনে গড়ে ২২ কোটি ঘনফুট।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে বড় ধরনের অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ সরবরাহ ধরে রাখা যায়নি। দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আনা হচ্ছে কম। তাই এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ। সরবরাহ কমলে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার শিল্পকারখানাগুলো বেশি সংকটে পড়ে। সূত্রমতে, আগামী মার্চ নাগাদ গ্যাসের সরবরাহ বাড়তে পারে।

আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এটি আবার চালুর কথা। দুটি টার্মিনাল মিলে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন শুধু সামিট গ্রুপের ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে।

একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ একটু কম। তাই কাঙ্ক্ষিত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব, অপারেশনস অ্যান্ড মাইনস) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী

অন্যদিকে উৎপাদনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র হবিগঞ্জের বিবিয়ানায় উৎপাদন কমছে। যদিও বিকল্প হিসেবে সম্প্রতি ভোলা থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করে সরবরাহ শুরু হয়েছে ঢাকার আশপাশের কিছু শিল্পকারখানায়।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব, অপারেশনস অ্যান্ড মাইনস) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ একটু কম। তাই কাঙ্ক্ষিত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এলএনজি সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে।

আরও পড়ুন

‘শিল্পের উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগ’

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ এলাকায় অবস্থিত রপ্তানিমুখী টোটাল ফ্যাশন লিমিটেড সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শুক্রবার গ্যাস পেলেও অন্য দিন সেভাবে পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসিব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-সংকটে কারখানার উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সংখ্যা আট শতাধিক। ডাইং প্রতিষ্ঠান তিন শতাধিক। সবখানেই গ্যাসের সংকট আছে। পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত রপ্তানিমুখী ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রতিদিন কাপড় উৎপাদনের ক্ষমতা ৩০ টন। এখন উৎপাদিত হচ্ছে ১০-১২ টন। এমএস ডাইং লিমিটেড বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। সক্ষমতা ৪০ টন হলেও উৎপাদিত হচ্ছে ১৫ টন।

রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকেরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে গ্যাসের চাপ ভালো থাকলেও অন্য দিন চাপ কমে যাচ্ছে। রপ্তানির স্বার্থে উৎপাদন ঠিক রাখতে শিল্পে সব সময় গ্যাস সরবরাহ রাখা দরকার।

গত শনিবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গ্যাস পাচ্ছে না মুন্সিগঞ্জের কারখানাগুলোও। প্রত্যাশা ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘লাইনের গ্যাস নেই। তাই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করছি।’

জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনার রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়েনি। আর তিতাস গ্যাস মুন্সিগঞ্জ কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. মেজবা উদ্দিন বলেন, মুন্সিগঞ্জে গ্যাস-সংকট দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে।

জ্বলছে না রান্নার চুলা, ভোগান্তি

রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকেরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার বাগবাড়ি এলাকার গৃহিণী আমেনা বেগম বলেন, ‘গ্যাস না থাকায় ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করছি। এতে প্রতি মাসে বাড়তি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। আবার তিতাস গ্যাসকেও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।’ শহরের মাসদাইর এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী মাকসুদা বেগম জানান, গভীর রাতে গ্যাস এলেও সকাল ছয়টার আগে চলে যাচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর ইসলামপুর এলাকার গৃহিণী বুলবুলি বেগম বলেন, গ্যাস নেই, এলপিজি কেনার সামর্থ্য নেই; তাই মাটির চুলায় রান্না করতে হয়। এমন দুর্ভোগ শুধু তাঁর একার নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রাজধানী ঢাকাতেও রান্নার জন্য গ্যাস পাচ্ছেন না অনেক গ্রাহক। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কলাবাগান, বসুন্ধরা, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তিতাসের অভিযোগকেন্দ্রে গ্রাহকের ফোন আসছে গ্যাস না পেয়ে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হাজেরা বেগম বলেন, মধ্যরাতে গ্যাস আসে, এরপর সকাল আটটার মধ্যেই চলে যায়।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজার এলাকার প্রীতম ইসলাম জানান, রাত একটার দিকে কিছু গ্যাস আসে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ফুরিয়ে যায়। তাই রাতে না ঘুমিয়ে রান্না করতে হয়।

বেশি দামে বিকল্প জ্বালানি

শিল্প-অধ্যুষিত গাজীপুরের বেশ কিছু এলাকায় গ্যাস-সংকট দেখা দিয়েছে। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে না পারায় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ছেন শিল্পকারখানার মালিকেরা। এ ছাড়া পোশাক ক্রেতাদের চাহিদামতো সময়ে উৎপাদন সরবরাহ করতে না পারলে অনেক সময় ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় খান ব্রাদার্স কারখানার এমডি হজরত আলী জানান, বারবার দাবি জানানো হলেও গ্যাস সরবরাহে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার ব্যবসায়ী নাহিদুল ইসলাম জানান, বাধ্য হয়ে ডিজেলের জেনারেটর চালাতে হয়। এভাবে ডিজেল ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।

তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গাজীপুর জোনের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. শাহাজাদা ফরাজী স্বীকার করেন, চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যায় না।

এলএনজি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার কথা বলেই দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন ডলার–সংকটে আমদানি করতে পারছে না। তাই স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর তৎপরতা না নিলে গ্যাস–সংকট থেকে ভোক্তা সহজে মুক্তি পাবেন না। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম

দেশি গ্যাস অনুসন্ধানের তাগিদ

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়ানো হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার নামে দাম বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ।

তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. নাছির উদ্দিন বলেন, সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে কিন্তু নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।

এ পরিস্থিতিতে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়ার তাগিদ দেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার কথা বলেই দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন ডলার–সংকটে আমদানি করতে পারছে না। তাই স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর তৎপরতা না নিলে গ্যাস–সংকট থেকে ভোক্তা সহজে মুক্তি পাবেন না। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর; প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জনারায়ণগঞ্জ]