প্রথম আলো-ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা–ভাঙচুর–আগুনের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে

বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার খবর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের প্রধান কার্যালয় ব্যাপক ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

এ কারণে আজ শুক্রবার প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা প্রকাশ করা যায়নি। এই দুই সংবাদমাধ্যমের অনলাইন পোর্টালও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

রয়টার্স

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘ছাত্রনেতার মৃত্যুর পর অস্থিরতায় বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, উচ্ছৃঙ্খল জনতা সংঘবদ্ধভাবে (মব) দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়।

দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে দেওয়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। ঘটনাস্থলে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আর ভবনের ভেতরে আটকে পড়া সাংবাদিকদের উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর বৃহস্পতিবার রাতে দ্য ডেইলি স্টার ভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীদের হেনস্তার শিকার হন। তখন বিক্ষোভকারীরা ভবনটিতে ভাঙচুর চালাচ্ছিল।

ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁকে ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মৌখিকভাবে ‘আওয়ামী লীগের সহযোগী’ বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তাঁর চুল টানা হচ্ছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে চারটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে প্রথম আলো কার্যালয়ে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। আরেকটি ছবিতে আগুন জ্বলতে দেখা যায় দ্য ডেইলি স্টার ভবনে।

বিবিসি

বিবিসির প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘আন্দোলনের তরুণ এক নেতার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল’। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁর শত শত সমর্থক রাজধানী ঢাকার একটি চত্বরে জড়ো হন। পরে বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর কার্যালয়ে ভাঙচুর চালান। এর মধ্যে একটি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শত শত মানুষ এখানে জড়ো হয়ে এই হামলা চালিয়েছেন।’

ঘটনাস্থলে সেনা মোতায়েন করা হয়। আর ভবনের ভেতরে আটকে পড়া সাংবাদিকদের উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বিবিসির প্রতিবেদনে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার দুটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে যুক্ত ভিডিওতে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার দৃশ্য রয়েছে।

গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে নাগরিক সমাজ
ছবি: প্রথম আলো

এএফপি

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর হাজারো বিক্ষোভকারী ঢাকার রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা তাঁর হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানান।

কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, রাজধানীতে কয়েকটি ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ভবনের মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ও রয়েছে। এতে ভবনের ভেতরে কর্মীরা আটকে পড়েন।

ফায়ার সার্ভিসের একজন মুখপাত্র বলেন, ঢাকায় অন্তত তিনটি অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর ভবন রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তাঁরা ধোঁয়ায় ভরা ভবন থেকে ২৭ জন কর্মীকে উদ্ধার করেন।

দ্য ডেইলি স্টার-এর পরামর্শক সম্পাদক কামাল আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘এই পত্রিকার ইতিহাসে এই প্রথম প্রকাশনা বন্ধ করতে হলো।’

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে পত্রিকা প্রকাশিত না হতে পারায় তিনি ‘গভীরভাবে মর্মাহত’।

সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘এই হামলা শুধু প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ওপর করা হয়নি; এটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রকাশ ও মতবৈচিত্র্যের ওপর করা একটি হামলা।’

এপি

বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘২০২৪ সালের আন্দোলনের একজন কর্মীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দুই দৈনিকের কার্যালয়ে প্রবেশ করে ভাঙচুর বিক্ষোভকারীদের’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন প্রভাবশালী কর্মীর মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা দেশটির শীর্ষস্থানীয় দুই সংবাদপত্রের কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালান। বিক্ষোভকারীরা দুই পত্রিকার ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে ভবনগুলোর ভেতরে সাংবাদিক ও অন্য কর্মীরা আটকা পড়েন।

কয়েক ঘণ্টা পর সাংবাদিক ও অন্য কর্মীদের উদ্ধার করা হয়। আগুন শুক্রবার ভোরে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার পরই ঢাকার রাস্তায় শত শত বিক্ষোভকারী নেমে আসেন। একপর্যায়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ের বাইরে এক দল বিক্ষোভকারী জমায়েত হন। বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় অনলাইন গণমাধ্যমের পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, এরপর তারা ভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।

প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৯ ডিসেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক শ গজ দূরে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার–এর কার্যালয়। আরেক দল বিক্ষোভকারী এই কার্যালয়ে ঢুকে ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

দুই ভবনের বাইরে সেনা ও আধা সামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

দ্য ডেইলি স্টার ভবনের বাইরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছালে বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে চলে যেতে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ভবনের ভেতরে কাজ করছিলেন সংবাদপত্রের কর্মীরা। আগুন দেওয়ায় তাঁরা ভবনের ভেতরে আটকা পড়েন। দ্য ডেইলি স্টার–এর সাংবাদিক জাইমা ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, তিনি তখন ভবনের ভেতরে ছিলেন।

শুক্রবার ভোর নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

উভয় দৈনিকই এই হামলার পর তাদের অনলাইন সংস্করণ আপডেট বন্ধ করে দেয়। শুক্রবার তারা কোনো মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশ করেনি।

আল–জাজিরা

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা অনলাইনে ‘বিশিষ্ট প্রতিবাদী নেতার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনে ভূমিকা রাখা এক তরুণ নেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩২ বছর বয়সী এই নেতা গত সপ্তাহে ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার সে দেশের এক হাসপাতালে তিনি মারা যান।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, রাতভর সহিংসতায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আগামীকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে এবং সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

ডন

পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন ‘আহত যুবনেতার মৃত্যুর পর ঢাকায় সহিংস বিক্ষোভ ও ভবনে অগ্নিসংযোগ’ শিরোনামে বেশ কয়েকটি ছবি দিয়ে অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাওয়া এক যুবনেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাজপথে নেমে আসেন।

গত বছর গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান মুখ ৩২ বছর বয়সী শরীফ ওসমান হাদি গত সপ্তাহে ঢাকার একটি মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় বন্দুকধারীদের গুলিতে আহত হন। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে খুনিদের বিচারের দাবিতে তাঁর সমর্থকেরা ঢাকায় জড়ো হন।

কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বিক্ষোভকারীরা শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের কার্যালয়সহ বেশ কিছু ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে।

দ্য হিন্দু

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে সহিংসতার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের নিন্দা নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে তারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আজ শুক্রবার সাম্প্রতিক সহিংসতার ঢেউ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন বার্তা সংস্থার বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন, যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান, জার্মানির ডয়চে ভেলে, ভারতের এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফ্রান্স ২৪ ডটকমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারে অগ্নিসংযোগ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।