সংকট কাটেনি, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ কার্যত বন্ধই আছে
রাজধানীর মগবাজার থেকে মালিবাগ পর্যন্ত রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সারি সারি নির্মাণাধীন কাঠামো দেখা যায়। তবে চার মাস ধরে কাঠামোগুলো এভাবেই পড়ে রয়েছে।
গত মঙ্গলবার এই পথে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় আশপাশের কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁরা বলেন, কাঠামো নির্মাণে একসময় শত শত শ্রমিককে কাজ করতে দেখেছেন। কিন্তু এখন একজন শ্রমিকও নেই।
মগবাজারে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি ‘স্টকইয়ার্ড’ (নির্মাণকাজ পরিচালনার স্থান) আছে। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একজন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া কেউ নেই। অবশ্য তিন মাস আগে গত ২ এপ্রিল দেখা গিয়েছিল, সেখানে কাজ বন্ধ, তবে ১০-১২ জন শ্রমিক আছেন।
অংশীদার বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ব্যাংকঋণ নিয়ে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রকল্পটির নির্মাণকাজ কার্যত বন্ধই রয়েছে। শুধু হাতিরঝিল অংশে অল্প কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে।
শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব ও অর্থসংকটের কারণে কাজ বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করেছে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড। প্রথম আলোর এক ই-মেইলের জবাবে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, অর্থ জোগাড়ে অগ্রগতি হয়েছে। আগস্টের মধ্যে নির্মাণকাজ আবার শুরু করতে পারবে তারা।
যদিও গত ৩ এপ্রিল প্রথম আলোর ই–মেইলের জবাবে প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, স্বল্প সময়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে তারা ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করবে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছের কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। পুরো উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হাতিরঝিল-সংলগ্ন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ শেষ হয়েছে।
নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য কাওলা, মগবাজার, কমলাপুরের টিটিপাড়া ও কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে ওয়ার্ক স্টেশন-স্টকইয়ার্ড রয়েছে। সেখানে মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কাওলা স্টকইয়ার্ডে গত ফেব্রুয়ারি থেকে, আর বাকিগুলোতে গত মার্চ থেকে কাজ বন্ধ।
আদালতের নির্দেশে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে বলে একটি পক্ষের তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে এই তথ্য সত্য নয় বলে জানিয়েছে এফডিইই। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আদালত শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। কিন্তু কাজ বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশ দেননি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দ্বন্দ্ব নিরসন করে অর্থ সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে বলা হয়েছে এফডিইইর অধীনে কাজ করা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এই প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড।
এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এফডিইই কোম্পানি লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট। কোম্পানির অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলো এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) নামে পরিচিত।
২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করা হয়। গত ২০ মার্চ বিএফডিসি গেট-সংলগ্ন নামার র্যাম্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে
গত মঙ্গলবার মগবাজার স্টকইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মারুফ হোসেন নামের একজন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছেন শুধু। তিনি বলেন, মার্চ মাস থেকে এখানে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এক মাস ধরে তিনিসহ আরেকজন নিরাপত্তা প্রহরী পালা করে স্টকইয়ার্ড পাহারা দেন। বাকি শ্রমিকদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এখানে একসময় দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করতেন।
স্টকইয়ার্ডের পাশের চায়ের দোকানে বসে থাকা কয়েক ব্যক্তি বলেন, মাস তিনেক ধরে কাজ বন্ধ দেখছেন। একই কথা বলেন স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি।
মালিবাগ থেকে হাতিরঝিলের যে অংশে কাজ চলছে, সেখানকার কয়েক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। মো. ইহসান নামের এক শ্রমিক বলেন, তিনি দেড় বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছেন। এখানে অল্প কয়েকজন কাজ করছেন। বাকিদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। কাজ শুরু হলে আবার ডাকা হবে বলা হয়েছে। তবে কবে ডাকা হবে সময় জানানো হয়নি।
বিরোধ গড়িয়েছে আদালতে
প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে ঋণচুক্তি করেছিল। প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার চুক্তিতে এফডিইইর অধীনের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের শেয়ারের অনুপাতে নির্দিষ্ট হারে বছরে দুবার সুদ পরিশোধ করার শর্ত দেওয়া হয়।
এফডিইই সূত্রে জানা গেছে, চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান সময়মতো সুদ পরিশোধ করলেও সবচেয়ে বড় শেয়ারধারী ইতালিয়ান-থাই তা করতে পারেনি। শর্ত অনুসারে সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠান তার শেয়ারের অংশ অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবে। এ অবস্থায় চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার নিতে চাইলে ইতালিয়ান-থাই রাজি হয়নি।
এ অবস্থায় গত ১৭ জানুয়ারি চীনা ব্যাংক দুটি ঋণের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। তখন সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে সালিস নোটিশ পাঠায় ইতালিয়ান-থাই। একই সময়ে তারা হাইকোর্টে শেয়ার হস্তান্তরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির আবেদন করে স্থিতাবস্থা পায়।
তবে গত ১২ মে হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা তুলে দেন। এই সিদ্ধান্ত স্থগিত চেয়ে ইতালিয়ান-থাইয়ের করা আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে গত ১৬ মে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। আদালত শেয়ার হস্তান্তরের ওপর ৩০ মে পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন। পরে ইতালিয়ান-থাইয়ের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ মে আপিল বিভাগ সিঙ্গাপুরে সালিসির প্রথম বৈঠক বসা পর্যন্ত স্থিতাবস্থার মেয়াদ বাড়ান। আদালত প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ করার কোনো নির্দেশ দেননি।
‘আগস্টের মধ্যে কাজ আবার শুরু হবে’
এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরকি ভাস্কন খান্নাভা প্রথম আলোর ই–মেইলের জবাবে ১ জুলাই বলেন, প্রকল্পের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটলে সব আর্থিক প্রক্রিয়া শেষে আগস্টের মধ্যেই নির্মাণকাজ আবার শুরু করবে এফডিইই।
ভাস্কন খান্নাভার ই–মেইলে আরও বলা হয়, ইতালিয়ান-থাইয়ের সঙ্গে চীনা ঋণদাতা ও অংশীদারদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই এফডিইইর শেয়ার স্থানান্তর চায় ইতালিয়ান-থাই। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আগস্ট পর্যন্ত শেয়ার হস্তান্তর না করার পক্ষে স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। আদালত নির্মাণকাজ বন্ধের কোনো নির্দেশ দেননি। ইতালিয়ান-থাই ও দুই চীনা অংশীদারদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর বিষয়টি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকার যতটুকু সম্ভব নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে এই বিরোধ যদি বেশি দীর্ঘ হয়, প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বাধা তৈরি করে, তাহলে তা সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
চীনা দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের (শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ও সিনোহাইড্রো) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যাংকে সুদ পরিশোধ করে তারা এখন বিপাকে। ইতালিয়ান-থাই সুদ পরিশোধ করেনি। উল্টো বেশি শেয়ার রাখার সুবিধা নিতে চায়। নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় তারা বিনিয়োগ করেও লাভবান হচ্ছে না। পুরো প্রকল্প দ্রুত শেষ না হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ সরকারেরও লাভ হবে না।
প্রকল্পটির পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।’