দুর্লভ গেছো ছুঁচো

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বন বিটে শততর্ষী পাকুড়গাছে এক গেছো ছুঁচোছবি: লেখক

সোয়া দুই বছর আগের ঘটনা। সকাল আটটা থেকে বসে আছি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বন বিটের নাম না জানা এক পাহাড়ের ওপর। সামনে শতবর্ষী এক পাকুড়গাছ। গাছে নানা প্রজাতির পাখির মেলা বসেছে যেন!

তবে যে পাখির খোঁজে এসেছি, তার দেখা এখনো পাইনি। তার খোঁজ করতে করতে কালোখোঁপা বুলবুলি, গোরখোদ বসন্তবাউরি, নীলগলা বসন্তবাউরি, ভাগীরথ পাখি, কমলাগলা চটক, কালোডানা গুধুকা ও জলপাই তুলিকার দেখা পেলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ১০টা বেজে ৫১ মিনিট হয়ে ২০ সেকেন্ড। এ সময় হঠাৎই বর্ষীয়ান পাকুড়গাছের খোঁড়ল থেকে একটি বাদামি কাঠবিড়ালি বেরিয়ে এসে সামনের মোটা ডালে রোদ পোহাতে লাগল। বাদামি কাঠবিড়ালির ছবি জীবনে প্রচুর তুলেছি। তাই অল্প কটি ক্লিক করে পাখির ছবি তোলায় মনোযোগ দিলাম। স্তন্যপায়ী প্রাণীটির দিকে আর ফিরেও তাকালাম না।

দুপুর ১২টা নাগাদ পাহাড় থেকে নিচে নেমে প্রায় ৩ ঘণ্টা এদিক-সেদিক ঘুরে বেলা ৩টায় আবারও পাহাড়ে উঠলাম। উঠেই আলতাপরির দেখা পেলাম। এরপর তিন প্রজাতির পাখির ছবি তুলে বাদামি কাঠবিড়ালিটির বাসার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, দিব্বি আছে সে ওখানে, রোদ পোহাচ্ছে। খানিক পরে রোদ পোহানো ছেড়ে গাছে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। গাছে আর কোনো পাখি না আসায় এবার ওর দিকে একটু ভালোভাবে লক্ষ করতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল।

আমরা সেই সকাল থেকে কী ভুলটাই না করছিলাম! যে দুর্লভ প্রাণীকে কিনা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে খুঁজছি, সকালে তাকে সামনে পেয়েও চিনতে পারিনি। কারণ, সে সকালে মাথা নিচু করে থাকায় তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুচালো নাকটি চোখে পড়েনি। তাই তো চিনতে পারিনি। কাজেই সমানে ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করে গেলাম। দুর্লভ প্রাণীটির সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পেছনের ময়লার ভাগাড়ে, ২ মে।

মৌলভীবাজারের সাগরনাল পাহাড়ে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা প্রাণীটি এ দেশের এক দুর্লভ স্তন্যপায়ী প্রাণী গেছো ছুঁচো। বর্তমানে প্রাণীটি এ দেশে প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত। টুপাইডি গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Tupaia belangeri। বাংলাদেশ ছাড়াও ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রাণীটির দেখা মেলে।

গেছো ছুঁচো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পেছনের ময়লার ভাগাড়ে
ছবি: লেখক

গেছো ছুঁচো ছোট আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। দেখতে কাঠবিড়ালি ও ইঁদুরের মাঝামাঝি চেহারার হলেও মুখে গোঁফের অনুপস্থিতি এটিকে ওই দুটি প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। সুচালো নাক ও ঝোপালো লেজের প্রাণীটির দেহের দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। লেজও ২০ সেন্টিমিটার লম্বা। তবে কাঠবিড়ালির তুলনায় লেজ কম ঝোপালো। গড় ওজন ১৯০ গ্রাম। দেহের ওপরের অংশের লোম জলপাই-বাদামি, যাতে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দাগ রয়েছে। অন্যদিকে দেহের নিচের অংশের লোম হলুদাভ। আঙুলের মাথা উন্মুক্ত ও নখর ধারালো। লম্বা নাকের ওপর ত্বকের একটি অনাবৃত আবরণ থাকে। কান ছোট ও চোখ মাঝারি আকারের। স্ত্রী ও পুরুষ প্রাণী দেখতে একই রকম।

এগুলো বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের পত্রঝরা বন ও আশপাশের এলাকায় বাস করে। দিবাচর ও আধা ভূচারী প্রাণীটি গাছের নিচের দিকের শাখা, ঝোপঝাড় ও মাটিতে বিচরণ করে। সচরাচর একাকী দেখা যায়। দ্রুত চলাফেরা করে ও প্রতিবারে দুই পায়ের সাহায্যে মাটিতে ভর করে লাফ দেয়। বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ ও ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করে। খাওয়ার সময় কাঠবিড়ালির মতো সামনের পায়ের সাহায্যে খাবার ধরে রাখে।

এগুলো বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। স্ত্রী ও পুরুষ সারা জীবনের জন্য জোড় বাঁধে। সচরাচর গাছের খোঁড়লে পাতা ও কাঠিকুঠি দিয়ে বাসা বানায়। স্ত্রী ৪০ থেকে ৫২ দিন গর্ভধারণের পর সচরাচর দুটি বাচ্চার জন্ম দেয়। সাধারণত বছরে একবারই প্রজনন করে থাকে। বাচ্চারা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগপর্যন্ত মা–বাবার সঙ্গে একই বাসায় থাকে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ