সাহস ও সংগ্রামের অনন্য দৃষ্টান্ত ফিরোজা খাতুন

সংগ্রাম, সাহস আর আত্মনির্ভরতার গল্প—হার না মানা ফিরোজা খাতুন
ছবি: বাংলালিংকের সৌজন্যে

ফিরোজা খাতুন, যশোরের নাভারনের এক সংগ্রামী নারীর নাম। জীবন যখন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তখন কেউ হার মানে, কেউ সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে যায়। ফিরোজা খাতুনের জীবনেও নেমে এসেছিল ঘন অন্ধকার, তিনিও হয়েছিলেন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। অন্ধকারের অতলে হারিয়ে না গিয়ে তিনি বেছে নেন লড়াইয়ের পথ। জীবনের এক কঠিন মোড়ে এসে একলা হয়ে যান ফিরোজা। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান, ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে অকূলে পড়ে যান তিনি। মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন—কী হবে এখন? সংসারের খরচ, সন্তানদের ভবিষ্যৎ, নিজের অস্তিত্ব—সবকিছুই যেন অনিশ্চয়তার মধ্যে। কিন্তু হার মানেননি ফিরোজা। কারও ওপর নির্ভর না হয়ে নিজের শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সংসারের দায়িত্ব একা হাতে সামলানোর অঙ্গীকার নিয়ে শুরু করেন সামনের দিকে পথচলা।

স্বামী ছিলেন ফিরোজার নির্ভরতার জায়গা। কিন্তু স্বামীই যখন তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন, তিনি আর কারও ওপর নির্ভরশীল হতে চাননি। এমনকি সেই কঠিন সময়ে নিজের ভাইবোনের কাছেও সাহায্য চাননি। বরং নিজেই নিজের পথ তৈরির সংকল্প নেন ফিরোজা। দিনবদলের কঠিন সংগ্রাম শুরু করেন। শুরুটা ছিল সামান্য, কিন্তু স্বপ্ন ছিল অনেক বড়।

ফিরোজা খাতুন বলেন, ‘আগের কথা মনে পড়লে কষ্ট তো এখনো হয়। কষ্টের মুহূর্তে আসলে কেউ পাশে থাকে না। তবে সেই সময়ে আমার বাংলালিংকের এক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি বলেছিলেন, আপনি চাইলেই নিজের জীবন বদলে ফেলতে পারেন। ভাইয়ের কথামতোই আমি বাংলালিংকের রিচার্জের সিম নিই। যেহেতু আমি ইন্টার পাস করেছি, তাই তিনি আমাকে প্যারা-মেডিকেলের একটি কোর্স করারও পরামর্শ দেন। তাঁর কথা শুনেই প্যারা-মেডিকেলের কোর্সটি করি, যাতে আমি গ্রাম্য-ডাক্তার হিসেবে কাজ করতে পারি।’

শুরুর দিকটা তেমন সহজ ছিল না। ফিরোজা বাড়ির এক কোণে ছোট্ট একটা দোকান দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। মোবাইল রিচার্জ, ওষুধ, প্রসাধনী সামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। প্রথম দিকে দোকান থেকে খুব একটা আয় হতো না বললেই চলে। তবে তিনি লক্ষ করলেন, এলাকায় কিছু জরুরি পণ্য পাওয়া যায় না। তাই দোকানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা তৈরি করে নিয়ে আসতে থাকেন নতুন নতুন সামগ্রী। ধীরে ধীরে তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে এবং এলাকায় জরুরি হয়ে ওঠে তাঁর দোকানটি।

ফিরোজা খাতুন বলেন, ‘এভাবেই কঠিন সংগ্রাম করতে করতে একটা সময় আমার জীবন বদলে গেছে।’

দোকান চালিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে থাকেন ফিরোজা। সমাজের নানা বাধা, অনেকের কটুকথা পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান স্বপ্নপূরণের পথে। নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রতিদিন নতুন উদ্যমে কাজ করেন। কোনো প্রতিকূলতাই তাঁকে রুখে দিতে পারেনি।

ফিরোজা খাতুন আজ শুধু একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি সাহসের অনন্য এক প্রতীক, সংগ্রাম আর সংকল্পের গল্প। এক সংগ্রামী নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফিরোজা।

লড়াই করে নিজেই নিজের পথ তৈরি করেন তিনি। তাঁর এই দিনবদলের স্বপ্নপূরণে সব সময় পাশে ছিল বাংলালিংক। ফিরোজা খাতুনের এই সংগ্রামী পথচলা শুধু তাঁর একার জীবনের গল্প নয়, এটি অনেক নারীর অনুপ্রেরণার উৎস। সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, নারীদের সীমাবদ্ধ রাখার নানা প্রয়াস—সব পেরিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি জয় করা সম্ভব। আজ তাঁর জীবনের গল্প আশপাশের অনেক নারীর কাছে একটি উদাহরণ।

ফিরোজার গল্পই প্রমাণ করে যদি মনের জোর থাকে, যদি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস থাকে, তাহলে কারও ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই। ফিরোজার এই আত্মনির্ভরশীলতার গল্প শুধু নিজের পরিবারকেই পরিবর্তন করেনি বরং অন্যদের মধ্যেও জুগিয়েছে আত্মবিশ্বাস।