‘সঠিক’ ইতিহাসের বন্দী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেমিনার কক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র পড়ছিলাম। হঠাৎ একজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘আপনারা সব সময় সঠিক ইতিহাস তুলে ধরবেন, শুদ্ধ ইতিহাস।’ একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে দক্ষিণ এশিয়া কনফারেন্স প্যানেলে আলোচনা করছিলাম। আরেকজন অধ্যাপক বললেন, আমাদের প্রজন্ম নাকি ইতিহাসের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখায় না। প্রতিবারই কথাগুলোর মধ্যে এই অশনিসংকেত শুনতে পাই—আবারও কেউ এসে ঠিক করে দেবে কোন ইতিহাসটা ‘ঠিক’ আর কোনটা ‘ভুল’।
সম্প্রতি জাতীয় আর্কাইভে দলিলপত্র ঘাঁটছিলাম। কাগজগুলো হাতে নিয়ে বুঝলাম, ফটোকপির ফটোকপি। জানতে চাইলাম, মূল দলিলগুলো কোথায়? গবেষণাগারের রক্ষক শান্ত গলায় বললেন, ‘মূল দলিল বহু আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন কোনো সরকার এলেই কেউ না কেউ আসে। দরজা খুলে দেখে, কী আছে।’ সরকার বদল মানেই হঠাৎ ঝড়ের মতো পালাবদল। সবকিছু হবে নতুন। পুরোনো সব ধুয়ে, পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে গায়েব করে দেওয়া হবে। আগের আমলের সব নিদর্শন নতুন শাসকের চক্ষুশূল। ফাইল, ছবি, চিঠি—
সবকিছু সেই জোশের উন্মাদনায় নিঃশেষ করা হয়।
একটা পুরোনো আলোকচিত্র দেখেছিলাম—মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে, চোখে আগুন। সেই ছবি এখন ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে ঢুকে গেছে, তাদের নতুন শাখা উদ্বোধনের ঘোষণাপত্রে। ছবিটা কে তুলেছিল? কে অনুমতি দিল এভাবে ব্যবহার করতে? আরেকবার দেখি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রবীণেরা এক টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনচিত্রে। ভাষাশহীদদের স্মরণ, কিন্তু একই সঙ্গে টেলকো মার্কেটিং? দেশপ্রেম আর করপোরেট ট্যাগলাইন, পাশাপাশি, দুজনে দুজনার।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। অন্য একটি ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার, তাই শহীদ মিনারে রাজনৈতিক দলের চিরাচরিত দখল প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। সেই সুযোগে আমরা আমজনতা আয়োজন করে শহীদ মিনারে গেছি। রাত ১২টার পরও ভিড়, ফুল, গন্ধ, শব্দ। বন্ধুকে বললাম, ‘অন্য একটা অনুভূতি, আমরা অবশেষে এখানে!’ স্থপতি বন্ধু সালাহউদ্দিন আহমেদ হেসে বললেন, ‘সবই ভালো, কিন্তু দেখো, সবাই ব্র্যান্ডেড হেডব্যান্ড পরে আছে। ওগুলো মোবাইল কোম্পানির।’
সালাহউদ্দিন আহমেদের কথা শুনে দমে গেলাম। আমরা যারা আশির দশকে বড় হয়েছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান একসময় ছিল নিষিদ্ধ রীতি-রেওয়াজ। সে সময়ের জনসমুদ্র দেখে মনে হচ্ছিল, নবীন প্রজন্ম ফিরে পেয়েছে ইতিহাসচর্চার অধিকার। সালাহউদ্দিন মনে করিয়ে দিলেন, ‘এটা ইতিহাস নয়, মার্কেটিং।’ স্মৃতি আর পণ্য যখন এক হয়ে যায়, আসল বলতে তখন কী থাকে? আজকাল ইতিহাসের বিজ্ঞাপন ওঠে, স্মৃতির বিলবোর্ড নামে। আমরা হাততালি দিই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, করপোরেট-দয়া ছাড়া কি ইতিহাস হবে না?
তবে ইতিহাস এখন শুধু বিজ্ঞাপনে নয়, রাজনীতির খেলাতেও আটকে গেছে। রাজনীতিবিদেরা বারবার ঢুকে পড়ছেন ইতিহাসের তদারকিতে—দলিল ঘেঁটে, নিজেদের পছন্দমতো কাটাছেঁড়া করে। কখনো পুরস্কার দিয়ে নিজের লোক বানিয়ে কাউকে কাছে টেনে নিচ্ছে; আবার কেউ কথা না শুনলে তাদের নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। কিছু ইতিহাসবিদ পাদটীকা, সূত্র, প্রসঙ্গ ছাড়াই ইতিহাসের চূড়ান্ত সব কিতাব লিখে ফেলছেন। সবই রাজনৈতিক অসিলার অংশ।
ফরমায়েশি ইতিহাস যাঁরা লিখছেন, তাঁরা বুঝতে চান না, আজ যারা ক্ষমতায়, কাল তারা পতিত। আর সবকিছু যখন পাল্টে যাবে, তখন নতুন সরকার নিজেদের মতো করে আবার ‘শুদ্ধ ইতিহাস’ লিখবে। এই একই চক্র বারবার। আজকের নায়ক কালকের খলনায়ক। আমাদের রাজনৈতিক মেরুকরণ যার যার আধিপত্যের সময় তাদের দৃষ্টিকোণের বাইরে ইতিহাস চর্চা করতে দেয় না। হোক সেটা সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন, খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান বা মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড। আমাদের ইতিহাসে বহু ঘটনা ধূসর, স্ববিরোধী, অস্পষ্ট। কিন্তু কেউ সেই ধূসর জায়গায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ইতিহাস বুঝতে চান না।
কার ইতিহাস সত্য—এই তর্কগুলো হতে পারত একটা ডায়ালেক্টিক, দ্বন্দ্ব থেকে নতুনের উৎপত্তি। কিন্তু সেই ডায়ালগও শোরগোল হয়ে গেছে। চিৎকার বাড়ছে, কথা বোঝা যাচ্ছে না।
এমনকি আদালতও এখন ইতিহাসের বিচারক হয়ে উঠেছেন। কখনো কখনো তাঁরাও রায় দিয়ে বলেন, কোন গল্প বা উপন্যাস ‘ভুল ইতিহাস’ শেখায়। একবার এক ব্লগার বন্ধু রাতে চা খেতে খেতে বললেন, ‘সত্যিকারের ইতিহাস বলে দুনিয়ার কোথাও কিছু নেই। সব জায়গায় মেকআপ দেওয়া মুখ। কেউ গোলাপজল ছিটায়, কেউ সাজগোজ করে, তারপর ক্যামেরা অন করে।’ কার ইতিহাস সত্য—এই তর্কগুলো হতে পারত একটা ডায়ালেক্টিক, দ্বন্দ্ব থেকে নতুনের উৎপত্তি। কিন্তু সেই ডায়ালগও শোরগোল হয়ে গেছে। চিৎকার বাড়ছে, কথা বোঝা যাচ্ছে না।
উদাহরণ হিসেবে মঈদুল হাসানের উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল (২০১৪) বইটির কথা ধরা যাক। বহু প্রতীক্ষার পরে মূলধারা ’৭১-এর (১৯৮৫) ধারাবাহিকতায় এ বই প্রকাশিত হয়। আশির দশকে দীর্ঘ এক অবসাদের পর, মূলধারা ’৭১ আর জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি (১৯৮৬) খুলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনার দরজা। মূলধারা ’৭১ বিশ্লেষণ করেছিল তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধ পরিচালনার জটিল কাঠামো। উপধারা একাত্তর-এ মঈদুল হাসান তুলে আনলেন মানিক মিয়ার ভূমিকা, যিনি ছয় দফা বাস্তবায়নের শুরুতে ‘গো স্লো’ কৌশলের পক্ষপাতী ছিলেন। করাচিতে হৃদ্রোগে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু তৈরি করেছিল এক বড় শূন্যতা, তরুণ র্যাডিক্যাল নেতারা যা দ্রুত পূরণ করেছিলেন। তাঁরা আপস ছাড়াই ছয় দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি তোলেন। এর পরের ইতিহাস একাত্তরের গল্প, ‘কোনো আপস নয়’ মনোভাব যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে। এই ইতিহাস জটিল। তাই তার গভীরে যাওয়ার ধৈর্য থাকা দরকার।
তারিক আলী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লিখছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান তাঁর অদেখা থেকে গিয়েছিল। শামসুর রাহমানের কবিতার ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট’ তারিক আলীর চোখে পড়েনি।
মুক্তিযুদ্ধের আরেক ধারার ইতিহাস আছে, বামপন্থী লড়াইয়ের কাহিনি, যেমন হায়দার আনোয়ার খান জুনোর একাত্তরের রণাঙ্গন: শিবপুর (২০১১)। ইন্দিরা সরকারের মধ্যে তখন একটা ভয় কাজ করছিল, মুক্তিবাহিনীর ভেতরে বামপন্থীরা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের নকশালদের সঙ্গে হাত মেলাবে। তাই তাদের প্রতি সন্দেহ ছিল প্রবল। অনেক সময় বামপন্থীরা একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে সতর্ক থেকেছে ভারতের সেনাবাহিনীর চোখরাঙানির সামনে। একাত্তরকে বুঝতে গেলে এই অস্থির বামপন্থী অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েও খোলামেলা আলোচনা দরকার।
১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে ভাবা যাক। মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ তারিক আলী তাঁর পাকিস্তান: মিলিটারি রুলস অর পিপলস পাওয়ার (১৯৭০) বইয়ে লিখেছিলেন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের শেষ ধাপ শুরু হয়েছিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে। কিন্তু তারিক আলী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লিখছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান তাঁর অদেখা থেকে গিয়েছিল। শামসুর রাহমানের কবিতার ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট’ তারিক আলীর চোখে পড়েনি। তবু তারিক আলীর বই বাতিল না করে বরং তাঁর স্মৃতিচিত্রকে আমাদের বয়ানের পাশে রেখে পড়তে পারি। ইতিহাস সব সময়ই বহুপক্ষীয়, একরঙা মোটেই নয়।
১৯৭১ সাল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। সেই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হচ্ছে মুক্তচিন্তার চর্চা। আহমদ ছফা ভোরের কাগজ-এ একবার লিখেছিলেন, ‘একাত্তর মহাসিন্ধুর কল্লোল’। ইতিহাস সেই মহাসমুদ্রেরই মতো, যেখানে আছে বহু কণ্ঠ আর স্রোত। একাত্তর, এমনকি ইতিহাসের যেকোনো প্রসঙ্গ নিয়ে খোলামেলা ও গভীরতর গবেষণার জন্য প্রয়োজন এমন এক গ্রন্থাগার, যেখানে বইগুলো একে অন্যের সঙ্গে বিতর্ক, সংলাপ, দ্বিধা ও সৌন্দর্যে ভরপুর হবে। আর সেটা হবে অগণিত, বিশৃঙ্খল, কিন্তু জীবন্ত।
নাঈম মোহায়মেন
শিক্ষক, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র