ক্যানসার বিষয়ে সমাজে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। আছে অসচেতনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার। তাই ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো সচেতনতা। এ ছাড়া কায়িক পরিশ্রম করতে হবে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশেই ক্যানসার চিকিৎসাবিষয়ক আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের টিউমার ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম এ কথা বলেন।
ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে গত মঙ্গলবার এসকেএফ অনকোলোজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম।
এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ক্যানসার জয়, আমরাই পারি’। বাংলাদেশে ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনোসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা, প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম। পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
ক্যানসার হওয়ার পর বেঁচে থাকার হার কেমন এবং গত এক বছরে এর সংখ্যায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ৭৬৫ জন ক্যানসার রোগী আছেন। তবে ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশের জন্য এই হার বেশি। এই বৃদ্ধির পেছনে কারণগুলো হলো ঘনবসতি ও অল্প শারীরিক পরিশ্রম, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ ইত্যাদি। এসব কারণেই ক্যানসারের প্রবণতা দেশ ও বিশ্বজুড়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
বাংলাদেশে কোন ধরনের ক্যানসারের হার বেশি? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসারের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পাশাপাশি স্তন ক্যানসার, কোলন ক্যানসারসহ অন্যান্য ধরনও রয়েছে। তবে বর্তমানে মুখগহ্বরের ক্যানসার এবং হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের হার বাড়ছে।
ক্যানসার নির্ণয়ে যে দেরি হয়, সেটার কারণ কী কী? উত্তরে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ক্যানসার বিষয়ে কিছু ভুল ধারণা ও সামাজিক সমস্যা রয়েছে। যার মধ্যে অসচেতনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও লজ্জা অন্যতম। বিশেষ করে নারীরা ব্যথা অনুভব করলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না। তাই এ বিষয়ে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের অবহেলা ও ভুল ধারণার অবসান করাতে হবে। কারণ, ক্যানসার দ্রুত শনাক্ত না হলে চিকিৎসার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
প্রচলিত থেরাপিগুলোর প্রাপ্যতা সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরেন ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রেডিওথেরাপি মেশিনের কিছু অভাব রয়েছে, বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে পুরোনো কোবাল্ট মেশিনগুলো এখনো অনেক বিভাগীয় হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বগুড়ায় উন্নত মানের রেডিওথেরাপি ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। আর ইমিউনোথেরাপি বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর ও আধুনিক একটি পদ্ধতি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন ইমিউনোথেরাপির প্রয়োজনীয় ও জনপ্রিয় ওষুধগুলো সহজলভ্য। স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিও এই ওষুধ তৈরি করছে। আর টার্গেটেড থেরাপি এমন এক ধরনের চিকিৎসা যেখানে ওষুধ বিশেষভাবে ক্যানসার সেলকে লক্ষ্য করে কাজ করে এবং এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম। এ ধরনের ওষুধ সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় ও অত্যন্ত কার্যকর। বাংলাদেশেও এখন এই চিকিৎসা সহজলভ্য।’
ঢাকার বাইরে ক্যানসার চিকিৎসা পাওয়ার সুবিধা সম্পর্কে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিভাগীয় শহরগুলোয় দ্রুত উন্নতি হচ্ছে এবং চিকিৎসাসেবায় ধীরে ধীরে বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে। সেখানে অনকোলোজি, নেফ্রোলজি ও কার্ডিওলজি বিভাগের সমন্বয়ে অত্যাধুনিক হাসপাতাল চালুর প্রস্তুতি চলছে। শিগগিরই এসব অঞ্চলে ঢাকার মতোই মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে।
ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে জনসচেতনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনসচেতনতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবে সচেতনতা তৈরির কাজটি সময়সাপেক্ষ এবং এটা কখনোই এক মিনিট বা একটি বাক্যে তৈরি হয় না।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আশির ‘দশকে যক্ষ্মায় নাই রক্ষা, ক্যানসারের নাই অ্যান্সার’—এমন ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রচার, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, নাটক, গান এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিলবোর্ডের মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা হয়েছিল, যার ফলে যক্ষ্মায় এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তেমনি ক্যানসারের বিরুদ্ধেও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ, ধূমপানবিরোধী বিজ্ঞাপন, সিনেমা হলে ধূমপানবিরোধী প্রচারণা এবং সিগারেটের প্যাকেটে ভয়াবহ ছবি থাকলেও এগুলো যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে না। আরও কার্যকর প্রচার, সচেতনতামূলক নাটক, ভিডিও এবং ধারাবাহিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই লড়াইয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সব পক্ষকে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ক্যানসারের বিরুদ্ধে সত্যিকারের বিজয় পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের কোন কোন ধরনের মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়? জানতে চাওয়া হলে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে খুব সহজেই খুশি হয়ে যাই, আবার খুব দ্রুত ভেঙেও পড়ি। ক্যানসার রোগীরা সাধারণত কিছু মানসিক ধাপের মধ্য দিয়ে যান। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে চান না যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে রোগী বিষয়টি মেনে নেন এবং একসময় ভয় ও হতাশায় ডুবে যান—আমি বাঁচব না, আমার পরিবারের কী হবে ইত্যাদি। পাশাপাশি পরিবারও একই ধরনের মানসিক ধাক্কা খায়। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই বা সঠিক চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে ইত্যাদি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। অনেক সময় সুস্থ হওয়ার পরও রোগী মনে করেন যে সহকর্মীরা তাঁকে আগের মতো মেনে নেবেন না। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে যে ক্যানসার শুধু শরীরের রোগ নয়, এটি মনেরও রোগ। তাই শরীর ভালো রাখার জন্য মনকে ভালো রাখতে হবে। কারণ, মানসিক সহায়তা ক্যানসার চিকিৎসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’
ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের ভূমিকার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত একটি মানসম্মত চিকিৎসাপদ্ধতি। যেখানে ক্যানসার রোগীর পুরো চিকিৎসাযাত্রায় বিভিন্ন ধাপে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ একসঙ্গে কাজ করেন। প্রথমে প্যাথলজিস্ট বায়োপসি করে ক্যানসার নির্ণয় করেন, এরপর ইমেজিং বিশেষজ্ঞ রোগের ধাপ নির্ধারণ করেন। সার্জন রোগীর অস্ত্রোপচার করেন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট কেমোথেরাপি দেন, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট রেডিওথেরাপি দেন। চিকিৎসাজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাপনায় মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, রোগীর মানসিক সমর্থনে সাইকিয়াট্রিস্ট এবং পুষ্টির ভারসাম্য ঠিক রাখতে পুষ্টিবিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
‘আগামী ১০ বছর পর বাংলাদেশের ক্যানসার চিকিৎসা কোথায় দাঁড়াবে বলে আপনি মনে করেন?’ জানতে চাইলে ডা. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আশা করি, বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে কেউ আর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন না। তবে আমি মনে করি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই চিকিৎসা মাইগ্রেশন হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে রোগী ভারতে যাচ্ছে, ভারত থেকে রোগী সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে, আবার সিঙ্গাপুর থেকে কেউ কেউ আমেরিকা বা ইউরোপে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এই বৈশ্বিক প্রবণতাকে “মাইগ্রেশন চেইন” বলে। তবে আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে চিকিৎসাব্যবস্থায় এমন উন্নতি হবে যে বিশ্ব “একটি গ্রামে” পরিণত হবে। যেখানে রোগীরা নিজ নিজ দেশেই অত্যাধুনিক, মানসম্পন্ন, বিশ্বস্ত ও আস্থাপূর্ণ চিকিৎসাসেবা পাবেন।’