বৃষ্টিদিনে ভবনের যত্ন
বর্ষা মৌসুমে বাতাসে আর্দ্রতা থাকে সর্বোচ্চ, আর এর সঙ্গে ভবনের বিভিন্ন অংশে যদি পানির অনুপ্রবেশ ঘটে, তখনই শুরু হয় ভবনের ড্যাম্পনেস। বর্ষায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে ভবনে বসবাস মানেই স্বাস্থ্যঝুঁকি। ড্যাম্পনেস হচ্ছে ভবনের ক্রনিক ডিজিজ, পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, শুধুই সাময়িক ব্যবস্থাপনা!
প্লিন্থ ও ফাউন্ডেশন
বেজমেন্টবিশিষ্ট ভবনের বেজমেন্ট ফ্লোরে সাম্পপিটে জমা পানি অপসারণের জন্য সার্বক্ষণিক সাম্প-পাম্প ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া সাম্পপিট সংযোগকারী পাইপ নেটওয়ার্কে ব্লকেড বা জ্যাম থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে। বেজমেন্টের রিটেনিং ওয়াল শতভাগ পানি লিকেজ প্রতিরোধী হতে হবে।
বেজমেন্টবিহীন ভবনের চারপাশের ভূমির ঢাল বা স্লোপ যেন বৃষ্টির পানিকে ভবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ভবনের ড্যাম্প প্রুফ কোর্সের উপরিভাগে কোনো লিকেজ আছে কি না, সেটা নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনে মেরামত করতে হবে। ভবনের চারপাশের নর্দমা ও পিটগুলো আবশ্যিকভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে।
মাটির নিচের জলাধারের মুখ নিচ্ছিদ্রভাবে বন্ধ রাখতে হবে নতুবা ভারী বর্ষায় বাইরের দূষিত পানি কিংবা ব্যাঙ–পোকামাকড় প্রবেশ করতে পারে।
বাইরের দেয়াল
দেয়ালে ফাটল বা ক্র্যাক দেখা দিলে দ্রুত মেরামত করতে হবে। দেয়ালে কোনো প্রকার গাছ জন্মাতে দেওয়া যাবে না। সানশেড, কার্নিশ বা ড্রোপ ওয়ালের নিচে পানিপ্রতিরোধী জলপট্টি বা ড্রিপ কোর্স রাখতে হবে, যাতে পানি ভবনের দিকে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। ছাদসংলগ্ন প্যারাপেট ওয়ালের টপ ঢাল ভবনের বাইরের দিকে নয়, ছাদের দিকে থাকবে, নতুবা পানি গড়িয়ে বাইরের দেয়ালের রং নষ্টসহ দেয়ালকে ড্যাম্প করে ফেলবে। এ ছাড়া দেয়ালে নির্দিষ্ট উচ্চতা পরপর অনুভূমিক গ্রুভের সংস্থান থাকলে ভবনের বাইরের পানির অবাধ প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেয়ালকে ড্যাম্পমুক্ত রাখবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে নির্গত পানি পাইপের মাধ্যমে নিচের নর্দমায় সংযোগ দিতে হবে। একটি বিশেষ কথা—ভেজা দেয়ালে রং করা যাবে না, প্লাস্টার বা আস্তরের আর্দ্রতা সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ থাকলেই কেবল দেয়ালে রং করা যাবে। বাজারে সাশ্রয়ী দামে ময়েশ্চার মিটার পাওয়া যায়, সংগ্রহে রাখা যেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ বায়ুমান নিশ্চিতকরণ
ভবনে বায়ু চলাচল উপযোগী বা ক্রস ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রাখুন। বৃষ্টি না থাকলে জানালা খুলে স্বাভাবিক বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর, এগজস্ট ফ্যান বা ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার ভবনকে শুষ্ক রাখবে। সিলিং কিংবা ওয়ালে ড্যাম্প স্পট দেখা যাওয়া মাত্র এর উৎস চিহ্নিত করুন, বাথরুম/পাকঘরের পানির লাইন কিংবা বাইরের রেইন ডাউন পাইপের সম্ভাব্য লিকেজ মেরামত করুন। ড্যাম্প স্পটের আস্তর ফেলে দিয়ে সময় নিয়ে পুনরায় আস্তর করুন, এরপর সম্পূর্ণ শুকনা মৌসুমে আর্দ্রতা মেপে রং করুন।
আজকাল বাসাবাড়িতে নানা রকম কৃত্রিম বোর্ডের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন এবং বিল্ট-ইন আসবাব দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে এসব ডেকোরেশন ও আসবাব ড্যাম্প হতে পারে। কাজেই এসব বোর্ডের আসবাব নির্মাণকালে অবশ্যই ভবনের দেয়ালে এনামেল পেইন্ট করে তার ওপরে ৩-৫ মিলিমিটার পিভিসি শিট বসাতে হবে, এর ওপরে বোর্ডের আসবাব ফিক্স করা উচিত, তাহলে এসব আসবাব ও কাপড়চোপড় ড্যাম্পমুক্ত থাকবে।
ছাদ এবং ছাদের পয়োনালাব্যবস্থা
বর্ষায় ভবনের ছাদের বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ছাদের ঢাল ঠিক আছে কি না, সেটা নিশ্চিত হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ছাদে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। বর্ষার প্রারম্ভেই বৃষ্টির পানিনিষ্কাশন পাইপের মুখ পরিষ্কার করতে হবে। ছাদের জলাধারে ওভার ফ্লো প্রতিরোধী চেক বাল্বের সংস্থান থাকতে হবে। জলাধার ও পানি সরবরাহ লাইনে লিকেজ দেখামাত্র মেরামত করতে হবে। জলছাদ ভবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটি একাধারে ভবনকে লিকেজ প্রতিরোধী ও তাপপ্রতিরোধী রাখে। জলছাদ ছিদ্র করা যাবে না, প্রয়োজনে ইটের গাঁথুনির বেস বানিয়ে সোলার প্যানেল, এসির আউটডোর ইউনিট বা পাইপ পোস্ট বসানো যাবে। জলছাদ ছিদ্র করলে পানি প্রবেশ করে ছাদ ড্যাম হবে এবং সিলিংয়ের রং ঝরে যাবে। ছাদের জলাধারের পানি সরবরাহ লাইনগুলো ছাদের ওপর না বসিয়ে প্যারাপেট দেয়ালের ভেতরের সারফেস দিয়ে ক্ল্যাম্পিং করে টেনে নেওয়াই উত্তম, তবেই ছাদ অধিকতর ব্যবহার উপযোগী ও শুষ্ক থাকবে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো চিলেকোঠা বা লিফট মেশিন রুমের দরজা। এ ক্ষেত্রে দরজার প্রবেশপথে মেঝেতে বৃষ্টির পানি প্রবেশ বাধা দেওয়ার জন্য চার থেকে ছয় ইঞ্চি উচ্চতার ডোর-সিল বসাতে হবে, অতঃপর দরজা আবশ্যিকভাবে ছাদের দিকে খোলার সংস্থান রেখে বসাতে হবে। তবেই দরজার গা বেয়ে বৃষ্টির পানি ভবনের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে না। ড্যাম্পমুক্ত ভবন নিশ্চিতকরণে বিষয়টি খেয়াল রাখা একান্ত জরুরি।
বৈদ্যুতিক স্থাপনা
কোনো অবস্থাতেই ভবনের লিফট-কোর বা স্যাপ্টে পানি প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। পানির সংস্পর্শে লিফটের সেনসরসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে পারে। বর্ষায় ঝড় কিংবা ভারী বৃষ্টিপাতে ছাদের সোলার প্যানেল স্থানচ্যুত হতে পারে, দক্ষিণমুখী করে ২৩ ডিগ্রি কোণে সোলার প্যানেল পুনঃস্থাপন করতে হবে। বর্ষায় ভবনের আর্থিং ব্যবস্থা পরীক্ষা করে নেওয়া উত্তম, এতে মূল্যবান ইলেকট্রোমেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি সুরক্ষিত থাকবে।
কাজেই বর্ষায় ভবনের যত্ন নিন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি ভবনের স্থায়িত্ব বাড়াতে সচেতন হোন।
মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (অব.), গণপূর্ত অধিদপ্তর
ই–মেইল: [email protected]