জলাবদ্ধতা ও মশা নিধনে বরাদ্দ থাকে, খরচ হয় না

১ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা। জলাবদ্ধতা ও মশকনিধন কর্মসূচিতে বরাদ্দ মাত্র ৩৫ কোটি টাকা।

১ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় পুরোনো নগর ভবনের কে বি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তন, ২১ জুন
ছবি: প্রথম আলো

অল্প কিংবা মাঝারি বৃষ্টি হলেই এখন নগর ডুবে যায়। জলাবদ্ধতার এ আতঙ্ক প্রতিবছর বেড়ে চলছে। নগরের বড় এ সমস্যা নিরসনে সিটি করপোরেশনের বাজেটে বরাদ্দ বরাবরের মতোই কম। অথচ এই কম বরাদ্দও খরচ করতে পারে না সংস্থাটি। একই অবস্থা মশকনিধনেও।

এবার জলাবদ্ধতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের দেড় শতাংশ। গত অর্থবছরে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও খরচ করেছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। মশকনিধন কর্মসূচিতে এবার রাখা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। এর আগের বছর ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলে খরচ করা হয় মাত্র ৯০ লাখ টাকা।

আজ বুধবার চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় পুরোনো নগর ভবনের কে বি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে বাজেট অধিবেশনে ১ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। আগের অর্থবছরে মূল বাজেট ছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজেটে টাকার পরিমাণ কমেছে ২৭৪ কোটি টাকা।

অধিবেশনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ হাজার ১৭৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার সংশোধিত বাজেটও ঘোষণা করেন মেয়র। এবারের বাজেট বাস্তবায়নের হার ৫৪ শতাংশ।  

বাজেট অধিবেশনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, করোনা-পরবর্তী এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করেছে। সিটি করপোরেশনও তা অনুসরণ করেছে। তবে বাজেটের আকার কমলেও নাগরিক সেবায় কোনো কাটছাঁট হবে না। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতার বাইরে থাকা ২১ খাল নিয়ে নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান যে প্রকল্পগুলো চলমান রয়েছে তার কাজ শেষ হলে সুফল আসবে।

অনুদান নির্ভরতা কমেছে, ভরসা নিজস্ব আয়

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী তাঁর মেয়াদে তৃতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন। গত দুই বাজেটে আয়ের মূল খাত ছিল উন্নয়ন অনুদান। তবে এবার নিজস্ব আয়ের ওপর নির্ভর করেছেন তিনি। এই খাতে মোট আয় ধরা হয়েছে ৯৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গৃহকর বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাকি টাকা আসবে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করসহ সাতটি খাত থেকে।

তবে মেয়রের প্রথম বাজেটে (২০২১-২২) নিজস্ব উৎস খাতে ৮৫২ কোটি টাকা আদায় করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ৪৭৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯০৪ কোটি টাকার বিপরীতে ৫০৬ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয় সিটি করপোরেশন।

সিটি করপোরেশনে এবার উন্নয়ন অনুদান খাতে আয় ধরা হয়েছে ৮৯৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকার বিপরীতে পেয়েছে ৬৪১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

বাজেট অধিবেশনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মো. বলেন, করোনা-পরবর্তী এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করেছে। সিটি করপোরেশনও তা অনুসরণ করেছে। তবে বাজেটের আকার কমলেও নাগরিক সেবায় কোনো কাটছাঁট হবে না।
রেজাউল করিম চৌধুরী , মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

নিজস্ব উৎসের ওপর নির্ভর করে দেওয়া বাজেটের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকার–গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিজস্ব আয়কে প্রাধান্য দেওয়ায় বাজেট বাস্তবায়নের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেননা, সিটি করপোরেশন চাইলেও রাতারাতি নগরবাসীর কাছ থেকে বেশি গৃহকর আদায় করতে পারবে না।

জলাবদ্ধতা, মশা নিধন নিয়ে সংশয়

নগরে খাল রয়েছে ৫৭টি ও নালা রয়েছে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি সংস্থা ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খাল ও ৩০০ কিলোমিটার বড় নালা খনন ও সংস্কার করা হবে। নগরের বাকি ২১টি খাল ও ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার নালা নিয়মিত পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ৩০ কোটি টাকার এই অল্প বরাদ্দ দিয়ে এসব খাল ও নালা পরিষ্কার করা অসম্ভব বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা
ফাইল ছবি

এদিকে কয়েক বছর ধরে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। প্রতিবছরই বাড়ছে সংক্রমণ। কিন্তু মশা নিধন খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে সিটি করপোরেশন।
সিটি করপোরেশনের বাজেটে উল্লেখযোগ্য ব্যয় ধরা হয়েছে উন্নয়ন খাতে ৯৪২ কোটি টাকা, বেতন, ভাতা ও পারিশ্রমিক খাতে ৩১০ কোটি টাকা, বকেয়া দেনা পরিশোধে ১২৫ কোটি টাকা।

জলাবদ্ধতা ও মশা নিধন কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে নামমাত্র বরাদ্দ প্রসঙ্গে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, বর্ষা এলেই মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে এই খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে তদারকির অভাবে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের আতঙ্ক বেড়েছে। এসব দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সিটি করপোরেশনের যে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, ঘোষিত বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।