ম্যাচমেকিং, নট পসিবল

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

নিউজফিড স্ক্রল করে যাচ্ছিলাম। একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল। একটা পাবলিক গ্রুপের ম্যাচমেকিং পোস্ট। যদিও এভাবে ম্যাচমেকিংয়ে খুব আগ্রহী নই, কিন্তু কমেন্টে বিভিন্ন মানুষের নিজেদের পরিচয় দেওয়ার ধরন, জীবনসঙ্গী নিয়ে প্রত্যাশা—লেখাগুলো ভালো লাগছিল পড়তে। রিঅ্যাক্টও করলাম কয়েকটায়।

পরদিন সকালে মেসেঞ্জারে একটি ছেলে জানতে চাইলেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী কি না। চেনা নেই, জানা নেই, এ কেমন মেসেজ! রাতের সেই পোস্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আসলে। পরে তিনি জানালেন, তাঁর কমেন্টে রিঅ্যাক্ট করেছি। তা দেখেই তিনি মেসেজ পাঠিয়েছেন।

ভদ্রলোকের ভুলটা ভাঙিয়ে জানিয়েও দিলাম কেন সেই পোস্টে রিঅ্যাক্ট করেছি। সুতরাং ম্যাচমেকিং নট পসিবল। তাঁর বোধ হয় চ্যাটিং করতে ভালোই লাগছিল। ম্যাচমেকিং প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেলেও বেশ কিছুক্ষণ চ্যাটে কথা হলো আমাদের।

এভাবেই অর্ক ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের কিছু পরেই রিকোয়েস্ট পাঠালেন। অবশ্য আমার অনুমতি নিয়েই। জানতে পারলাম তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। বিজনেস ফ্যাকাল্টির একটা ডিপার্টমেন্টে এমবিএ করছেন।

এর পর থেকেই টুকটাক কথা হতো চ্যাটিংয়ে। এতক্ষণ তো বলিইনি, ভাইয়ার ছন্দ মিলিয়ে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস ছিল। সেদিনের সেই ম্যাচমেকিং গ্রুপে ওই ছন্দে ছন্দে দেওয়া পোস্টটির জন্যই লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়েছিলাম।

একদিন ভাইয়া আমার ফ্যাকাল্টির সামনে এলেন। চা খেলাম। কিন্তু কেন যেন ভীষণ নার্ভাস লাগছিল ভাইয়াকে! অনেকেই নাকি প্রথম দেখায় মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে নার্ভাস থাকেন।

ধীরে ধীরে ভাইয়ার সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা হয়ে গেল। টুকটাক করে অনেক গল্প শেয়ার করতাম। ফার্স্ট ইয়ারে সিজিপিএ কেন কমে গিয়েছিল, সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির কোন খাবার ভালো লাগে, কোনটা লাগে না, পাঠক সমাবেশে আজ কোন বই পড়লাম—এ ধরনের অনেক খুচরা আলাপ।

একদিন ভাইয়া জানালেন তাঁর গোপন কথা। প্রথম বর্ষে ক্লাসমেট এক আপুর ওপর তাঁর বিশাল ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে। অবস্থা এমন হলো যে আপুকে দেখার জন্যই ভাইয়া ক্লাসে যান। দ্বিতীয় বর্ষে ভাইয়া ঠিক করলেন, আপুকে বলবেন সে কথা। কিন্তু বলতে বলতেই রোজার ঈদ চলে এল। ছুটিতে সবাই গেল বাড়িতে। ভাইয়া ঠিক করলেন, এবার বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেই বলে দেবেন আপুকে সব। কিন্তু...ঢাকা ফিরে শোনেন এবার বাড়ি গিয়ে আপু বিয়ে করে ফেলেছেন।

ভাইয়া যেভাবে গল্পটা বলছিলেন, তাতে শেষ পরিণতি এমন হবে ভাবতেই পারছিলাম না। শুনে এত খারাপ লাগল আমার। আপুকে দেখতে চাইলে ভাইয়া তাঁর ফেসবুক আইডি দেখালেন।

এভাবেই অনেক গল্প বলতেন ভাইয়া। আমি একটা মেয়ের তার পরিবার নিয়ে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষাগুলো জানতাম। কিন্তু একটা ছেলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জানতাম না। ভাইয়ার সঙ্গে চ্যাটিংয়ে যেন সেগুলো জানতে পারলাম ধীরে ধীরে। একটা ছেলে তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে কত রকম স্বপ্নজাল বুনে ফেলেছে, তা যেন দেখতে পেতাম আমি। ছেলেরাও এত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে! সত্যিই মাথায় আসেনি কখনো।

এভাবে ছয়-সাত মাস পেরোল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি ভাইয়া আমার প্রতি দুর্বল হচ্ছেন। সত্যি বলতে আমার কোনো দুর্বলতা কাজ করেনি কখনো। আমি বরং একজন ভালো গল্প করার মানুষ হিসেবেই তাঁকে দেখে এসেছি।

এরই মধ্যে এল ফেব্রুয়ারি মাস। শুরু হলো বইমেলা। ভাইয়া একদিন জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘বই কিনতে কবে যাবি।’ আমি জানালাম, এবার বইমেলা থেকে বই কেনা হবে না, হাতে টাকাপয়সা একদম নেই। ভাইয়া তাঁর অভ্যাসবশত ছন্দে ছন্দে লিখলেন, ‘মেলায় যাওয়ার কথা ভাবুন, বইয়ের চিন্তা আমার ওপর ছাড়ুন।’ ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইনি। তাই জানালাম, ‘নিজের বই নিজেই কিনে নিতে চাই।’ এরপর আর কথা হয়নি আমাদের।

কিছুদিনের মধ্যেই করোনা নামের মহামারি চলে এল। বন্ধ হয়ে গেল ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যেই আমার নানু অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গেলেন। নানুকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত বাসার সবাই।

এমনই এক রাতে সব কাজ শেষে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ একটা পোস্ট সামনে এল। ‘এবার করোনায় মারা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র।’ ছবি আর নামটা দেখে অজানা কোনো শক্তি যেন আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল।

‘অর্ক ভাইয়া—আমি চাইনি যে মানুষটা আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ুক, আমি চাইনি যে মানুষটা আমাকে বই কিনে দিক, মনে হচ্ছে চাইলে হয়তো মানুষটা অন্যভাবে ভাবত। হয়তো আমার কথা ভেবেই নিজের খেয়ালটা একটু বেশি রাখত।’

করোনার সময়গুলোতে কোনো এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাজ করেছিলেন। একদিন জ্বর আসে। তারপর...সেই জ্বর আর ভালো হয় না।

পুরোনো আলাপগুলোতে আবারও কেন চোখ বোলাতে গিয়েছিলাম সেদিন, জানি না! তবে সেই আপুটার আইডি সামনে আসতেই মনে হলো আপুকে আমিই জানিয়ে দেই, ‘মানুষটা ভীষণভাবে একটা কথা বলতে চেয়েছিল আপনাকে। কিন্তু পারেনি।’ কিন্তু লেখা হলো না। তার সেই রঙিন স্বপ্নজাল বোনা সম্পূর্ণ না হতেই তা যেন অতল সাগরে হারিয়ে গেল।

  • রুমানা নওশিন খান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়