পদ্মা সেতু চালুর ধাক্কা আকাশপথে

উড়োজাহাজপ্রতীকী ছবি

পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে ঢাকার সঙ্গে বরিশাল, যশোর রুটের যাতায়াত সহজ হয়েছে। তবে এতে আকাশপথে অভ্যন্তরীণ এই দুই রুটে যাত্রীসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

যাত্রী কমে যাওয়ায় দুটি বেসরকারি এয়ারলাইনস সংস্থা ঢাকা-বরিশাল রুটে ফ্লাইট পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লোকসান দিয়ে এই রুটে কোনোমতে ফ্লাইট চালু রেখেছে।

যাত্রী না পাওয়ায় ঢাকা-যশোর রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো। পাশাপাশি লোকসান কমাতে বেসরকারি দুটি এয়ারলাইনস কোম্পানি যশোর থেকে খুলনায় বাসসেবা বন্ধ করে দিয়েছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাগেরহাটে খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। সেখানে বিকল্প কী করা যায়, তা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।

এর মধ্যে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু হয়েছে। ফলে এ রুটেও আকাশপথে যাত্রী কমার আশঙ্কা করছে এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো।

অবশ্য আকাশপথে ঢাকা-সৈয়দপুর এবং ঢাকা-রাজশাহী রুটে যাত্রী চলাচল আগের মতোই আছে বলে জানা গেছে।

গত বছর ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৬ জুন যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু চালুর পরই আকাশপথে ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-যশোর রুটে যাত্রী কমতে থাকে বলে জানা যায়।

আকাশপথে যাত্রী কমার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-যশোর রুটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসে দিনে ৯৫০ থেকে ১ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতেন। এ সংখ্যা কমে এখন ২৮০ থেকে ৩০০ জনে এসে ঠেকেছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ঢাকা-যশোর রুটে যাত্রীসংকটের কারণে বেসরকারি এয়ারলাইনস কোম্পানিগুলো লোকসান গুনছে। তারা ভাড়া কমিয়েও যাত্রী পাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট বেসরকারি এয়ারলাইনস সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা তাঁরা দেখছেন না। যে পরিস্থিতি, তাতে অভ্যন্তরীণ দুটি বিমানবন্দর (বরিশাল ও যশোর) নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারে। তাঁরা এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পাশের দেশগুলোর সঙ্গে নতুন রুট খোঁজার চেষ্টায় আছেন।

অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে সে জন্য সময় লাগবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান মনে করেন, সাময়িক সময়ের জন্য এই দুই রুটে আকাশপথে যাত্রী কমেছে। তবে যাত্রী আবার বাড়বে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন হবে। তখন সড়কে যানজট তৈরি হবে। সময় বাঁচাতে তখন মানুষ আবার আকাশপথে যাতায়াত করবেন।

তবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জুলফিকার আলী মনে করেন, বিশেষ করে ঢাকা-বরিশাল রুটের আর ভবিষ্যৎ নেই। এই রুটে যাত্রী একেবারেই কমে গেছে। ঢাকা-যশোর রুটের অবস্থাও ভালো নয়। এখন উড়োজাহাজের জ্বালানির দাম বেড়েছে। সার্বিক খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে রাস্তাঘাট ভালো হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে। এতে সড়কপথে যাতায়াত আরও বাড়বে। আর আকাশপথে যাতায়াত কমে আসবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের দিনে দুটি ফ্লাইট ছিল। গত ১ অক্টোবর থেকে এই রুটের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় কোম্পানি। আরেক কোম্পানি নভোএয়ার এই রুটে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ১ আগস্ট। তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এই রুটে কার্যক্রম চালু রেখেছে। এই রুটে সপ্তাহে বিমানের তিনটি ফ্লাইট চলছে। তবে তা লোকসান দিয়ে চলছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী স্বীকার করেন যে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে মাহবুব আলী বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-বরিশাল রুটে দিনে সব মিলিয়ে ২৮টি উড়োজাহাজ চলাচল করত। সেটি কমে এখন সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট হয়েছে।

সড়ক ও আকাশ পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশালে যেতে সময় লাগছে চার ঘণ্টা। সড়কপথে যাত্রীদের যানজটে পড়তে হচ্ছে না। ফলে এই রুটে সড়কপথে যাত্রীর চাপ বাড়ছে। এই রুটের যাত্রীরা এখন আর উড়োজাহাজে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। অন্যদিকে, পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে খুলনায় যেতে এখন সময় লাগে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। এ কারণে ঢাকা-যশোর রুটে আকাশপথে যাত্রী কমে গেছে। এতে ফ্লাইট কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকারি-বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো।

পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-যশোর রুটে দিনে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ছয়টি ফ্লাইট চলাচল করত। সেটি কমে দুটিতে ঠেকেছে। একই চিত্র নভোএয়ারের ক্ষেত্রেও। আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট আগে চলত দিনে দুটি। এখন চলছে একটি।

নভোএয়ারের হেড অব এয়ারপোর্ট অপারেশন আবু রূশদ মোহাম্মদ শাহাদাত প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুট নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। ঢাকা-যশোর রুটেও যাত্রী তেমন আর পাওয়া যাবে না।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর আকাশপথে যাত্রী কমে গেছে, এ কথা ঠিক। তবে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। সেতু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানা হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। তখন আকাশপথে মানুষের যাতায়াত বাড়বে।

মোকাম্মেল হোসেন মনে করেন, বরিশাল ও যশোর বিমানবন্দর পুরোপুরি বন্ধ হবে না। উড়োজাহাজ চলবে। তবে সংখ্যায় কম হবে। এটা মেনে নিতে হবে।

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ১ ডিসেম্বর ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে এই রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে। এতে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে আকাশপথে যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বেসরকারি এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো।

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে এখন দিনে ইউএস-বাংলার ৯টি, নভোএয়ারের ৭টি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ৫টি ও এয়ার অ্যাস্ট্রার ৫টি ফ্লাইট চলাচল করছে বলে জানা যায়। ঢাকা-রাজশাহী রুটে দিনে ইউএস-বাংলার ২টি, নভোএয়ারের ২টি ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১টি ফ্লাইট চলছে।

এ ছাড়া ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে দিনে ইউএস-বাংলার ছয়টি, নভোএয়ারের ছয়টি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুটি ও এয়ার অ্যাস্ট্রার দুটি ফ্লাইট চলছে।

বেসরকারি এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো বলছে, ঢাকা-রাজশাহী ও ঢাকা-সৈয়দপুর—এই দুটি রুটে আকাশপথে যাত্রী স্বাভাবিক আছে। যাত্রী কমছে না, আবার বাড়ছেও না।

বাগেরহাটে বিমানবন্দর হচ্ছে না

পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় বাগেরহাটে ‘খানজাহান আলী বিমানবন্দর’ আর হচ্ছে না। প্রকল্পটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত জুনে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাগেরহাটে আর বিমানবন্দরের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এই বিমানবন্দর করতে অনেক বিনিয়োগের প্রয়োজন।

সূত্র বলছে, পিপিপিতে এই প্রকল্পে কোনো বিনিয়োগকারী পাওয়া যায়নি।

খানজাহান আলী বিমানবন্দর নিয়ে সরকার বিকল্প কিছু ভাবছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন।