মানা হয় না নিরাপত্তার শর্ত, পদে পদে ঝুঁকি

তিন দফা সময় বাড়ানোর পর প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। দিন দিন এই প্রকল্প চট্টগ্রামবাসীর জন্য হয়ে উঠেছে ‘মহাদুর্ভোগ’।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম নগরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলার সময় নালায় পড়ে মৃত্যু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই ঘটনা ঘটলেও প্রকল্প এলাকায় সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই ছিল। চলতি বছর এসে ঘটল আবার বড় দুর্ঘটনা।

৯ মার্চ নগরের প্রকল্প এলাকায় নালার খোলা অংশের মুখে থাকা রডে হোঁচট খেয়ে নালায় পড়ে আহত হন ইমরুল কায়েস চৌধুরী নামের এক ছাত্র। রডটি তাঁর পেটে ৮ ইঞ্চি ঢুকে যায়, পাঁজরের দুটি হাড়ও ভেঙে যায়। তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে ১০ দিন। এখন বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

এভাবে দুর্ঘটনার পরও সতর্ক হচ্ছে না সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‍্যাঙ্কিন। অথচ প্রকল্প শুরুর আগে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ২৯ শর্তে ছাড়পত্র নিয়েছে তারা। এসব শর্ত কাগজেই থেকে গেছে। বিভিন্ন স্থানে রয়ে গেছে নিরাপত্তাঘাটতি। শুধু নিরাপত্তাঘাটতি নয়, এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ নিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ছিল সমন্বয়হীনতা। তাই বেড়েছে মেয়াদ ও ব্যয়। তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। প্রায় চার বছর ধরে নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পড়ে আছে কাটা অবস্থায়। এতে চট্টগ্রামবাসী পোহাচ্ছেন ‘মহাদুর্ভোগ’।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ এসব গাফিলতির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
দেলোয়ার মজুমদার, সাবেক চেয়ারম্যান, আইইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্র

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সিডিএর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ঠিকাদারি পেয়েছে যৌথভাবে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ও চীনের প্রতিষ্ঠান র‍্যাঙ্কিন। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে তিন দফা সময় বৃদ্ধি করে এখন ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা।

সিডিএর প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, তাঁরা সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছেন। প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে।

শর্ত কাগজে, ঘাটতি রয়েই গেছে

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে ২৯ শর্তে ছাড়পত্র নিতে হয়েছে সিডিএকে। উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হচ্ছে, নির্মাণকাজ চলাকালে যানজট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকল্প এলাকায় ধুলাবালু যাতে না ওড়ে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। দূষণ কমানোর জন্য পরিপূর্ণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া ট্রাফিক সংকেত প্রদর্শন, নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক নির্দেশক বোর্ড থাকতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার প্রকল্প এলাকা ঘুরে শর্তগুলো পূরণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার গাফিলতি দেখা গেছে। চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার, দেওয়ানহাট, বারিক বিল্ডিং, নিমতলা ও কাস্টমস মোড়ে দেখা যায়, নির্মাণকাজের কারণে এসব এলাকায় সমানে ধুলা উড়ছে। কাস্টমস মোড়ে মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে উড়ছে ধুলা।

নগরের বারিক বিল্ডিং মোড়ে নিরাপত্তাঘাটতি দেখা যায়। সেখানে কোথাও টিনের ঘেরাও আছে, কোথাও ছিল না। আবার যেখানে টিনের ঘেরাও ছিল না, সেখানে বিটিসিএলের তার সরানোর জন্য গর্ত করা হয়েছে। এ রকম গর্ত থাকলেও তার পাশে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল না।

নির্মাণকাজের কারণে সড়কে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে এই রকম এক গর্তে পড়ে যান এক মোটরসাইকেলচালক। সড়কের এই অংশে বন্দরের পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক চলাচল করে।

এখন নিমতলা এলাকার পাশে গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। গার্ডার বসানোর জন্য বিশাল বিশাল আকৃতির যন্ত্র এনে রাখা হয়েছে। কিন্তু গার্ডার স্থাপনের এলাকা ছিল উন্মুক্ত।

জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মনির হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যত দিন কাজ চলবে, তত দিন ধুলাবালুর যন্ত্রণা মানুষকে সহ্য করতে হবে। কাজ চললে এ রকম দুর্ভোগ হবে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এগুলো কোনো দুর্ঘটনা নয়। প্রকল্প এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে মানুষের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ এসব গাফিলতির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না।