উদ্ধারকারী ট্রেনগুলো অনেক পুরোনো, সংখ্যায়ও কম

প্রতীকী ছবি প্রথম আলো

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে নতুন নতুন রেললাইন হচ্ছে। ট্রেনের চলাচলও বাড়ছে। একই সঙ্গে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনাও ঘটছে। তবে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী ট্রেন নেই রেলওয়ের। আবার যেগুলো আছে, সেগুলোও অনেক পুরোনো।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের আওতায় বর্তমানে ছয়টি উদ্ধারকারী ট্রেন আছে। এর মধ্যে অনেক দিনের পুরোনো একটির মেরামতকাজ চলছে। মাত্র পাঁচটি ট্রেন দিয়ে উদ্ধারকাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে রেলওয়ে। উদ্ধারকাজে বিলম্বের কারণে ট্রেন চলাচলের স্বাভাবিক সূচিও এলোমেলো হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

নতুন নতুন রেললাইন, স্টেশন নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যত আগ্রহ, উদ্ধারকারী ট্রেন কেনার ব্যাপারে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের তত আগ্রহ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, উদ্ধারকাজ দ্রুত করতে হলে আরও অন্তত তিনটি উদ্ধারকারী ট্রেন প্রয়োজন। বিশেষ করে কক্সবাজার রেললাইন চালু হওয়ায় উদ্ধারকারী ট্রেনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে। পুরোনো ট্রেনগুলো দিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় বেশি লাগছে। আবার পৌঁছালেও লাইনচ্যুত বগি উদ্ধারে বেগ পেতে হয়। অনেক সময় ২ ঘণ্টার কাজ করতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লেগে যায়।

ট্রেন পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। একটি অঞ্চল যমুনা নদীর পূর্ব পাশে, যা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে (ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহ বিভাগ) হিসেবে পরিচিত। আর যমুনা নদীর পশ্চিম পাশ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত (রাজশাহী-রংপুর-খুলনা বিভাগ)।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের আওতায় ছয়টি উদ্ধারকারী ট্রেন আছে। এগুলোর অবস্থান ঢাকা, চট্টগ্রাম, আখাউড়া, লাকসাম, ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী ও কুলাউড়ায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে থাকা উদ্ধারকারী ট্রেনটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় আছে। মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা চলছে। এর পরিবর্তে কুলাউড়ার ট্রেনটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে এনে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের উদ্ধারকারী ট্রেনটি ৫০ বছরের বেশি পুরোনো। এই ট্রেনটির সক্ষমতা মাত্র ২০ টনের। পুরোনো হওয়ায় ১০ থেকে ১২ টনের বেশি ভার উত্তোলন করতে পারে না। আবার এই ট্রেনের গতি ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। এটি মেরামত করা হচ্ছে।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০৩ কিলোমিটার। প্রতিদিন গড়ে ৫৪টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। মেইল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেন আছে ৭০টি। পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করে প্রতিদিন গড়ে ৮টি।

গত ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে অন্তত ৩৫টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে সাতটি করে দুর্ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার গাজীপুরের জয়দেবপুরে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

রেলওয়ের ট্রেন পরিচালনা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী ট্রেন না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে। এ সময় ট্রেনের পুরো সূচি ভেঙে পড়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত লাইনচ্যুত বা দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধার করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এর ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য নতুন আরও তিনটি উদ্ধারকারী ট্রেনের প্রয়োজন। এর মধ্যে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও লাকসামের জন্য একটি করে ট্রেন লাগবে। এই ট্রেনগুলো যদি পাওয়া যায়, তাহলে এই অঞ্চলের যেখানেই দুর্ঘটনা ঘটুক, সেখানে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এখন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে।

উদ্ধারকাজে সময় লাগছে বেশি

গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে গাজীপুরের জয়দেবপুর স্টেশনের এক কিলোমিটার দক্ষিণে ছোট দেওড়া এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা তেলবাহী ট্রেন ও যাত্রীবাহী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুটি ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত ও চারজন আহত হন।

ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন যেতে শুক্রবার বিকেল হয়ে যায়। লাইনচ্যুত ট্রেন লাইন থেকে সরানো হয় গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে। এরপর লাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে আরও কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। এ সময় একটি লাইন দিয়ে আসা-যাওয়ার ট্রেন চলাচল করে। ফলে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার ট্রেনগুলো এক থেকে ছয় ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করেছে।

এর আগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের চকরিয়ার ডুলাহাজারা এলাকায় লাইনচ্যুত হয় কক্সবাজারগামী স্পেশাল ট্রেন। গত ১৭ এপ্রিল সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে ডুলাহাজারা স্টেশনে বিশেষ ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর বেলা আড়াইটায়। উদ্ধারকাজ শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে। অর্থাৎ ট্রেন পৌঁছানো ও উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা লেগে যায়। স্টেশনে দুর্ঘটনা ঘটায় ট্রেন চলাচলে তেমন বিঘ্ন ঘটেনি। কেননা, লুপ লাইন দিয়ে অন্য ট্রেন চালানো হয়। যদি স্টেশনের বাইরে এই দুর্ঘটনা ঘটত, তাহলে ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকত।

গত ১৭ মার্চ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হাসানপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন ঢালুয়া ইউনিয়নের তেজের বাজার এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন। বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধারে তিন দিন সময় লাগে।

আবার এই উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার কারণে পাশের লাইনেও ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়। সব মিলিয়ে ২০টির বেশি ট্রেনের সময়সূচির বিপর্যয় ঘটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল বিভিন্ন স্টেশনে। পবিত্র রমজান মাসে এভাবে এই সূচি বিপর্যয়ের কারণে তীব্র ভোগান্তিতে পড়েছিলেন যাত্রীরা। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে তিন দিন সময় লাগে।

পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী ট্রেন না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাপস কুমার দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নতুন রুট ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকটও তৈরি হয়েছে। তাই নতুন উদ্ধারকারী ইঞ্জিন কেনার বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। তৎপরতাও চলছে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নতুন রেললাইন স্থাপন, ইঞ্জিন ও কোচ কেনার ব্যাপারে রেলওয়ের বেশি আগ্রহ। এ জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পও নেওয়া হয়। কিন্তু রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং উদ্ধার কার্যক্রমের ব্যাপারে তেমন কোনো মনোযোগ নেই। এ জন্য রেলওয়ের গাফিলতি দায়ী।