নিরাপদ সড়ক আশ্বাসেই থেকে গেল

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সরকার শিক্ষার্থীদের নানা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
ফাইল ছবি

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। ফুটপাতে বাসচাপায় সহপাঠীর মৃত্যুর পর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমেছিল। ধীরে ধীরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় থেকে বড়দের ভুল-বিশৃঙ্খলা ধরিয়ে দেয়।

আন্দোলন চলাকালে মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল, ‘শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে।’ তখন দায়িত্বশীল সবাই সড়ক নিরাপদ ও বিশৃঙ্খলমুক্ত করতে নানা আশ্বাস দেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে গেলে সবাই সব ভুলে গেছেন। আগের মতোই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, মৃত্যু হচ্ছে।

২০২১ সালের নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হলে আবার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। এবারও যথারীতি কিছু আশ্বাস এবং তাৎক্ষণিক কিছু দাবি মেনে নেওয়ার মধ্যেই উদ্যোগ সীমিত থাকে।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের মালুমঘাটায় পিকআপের ধাক্কায় ছয় ভাইয়ের মৃত্যু; ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় স্বামী, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও তাঁদের এক মেয়ের মৃত্যু এবং মৃত্যুর আগে গৃহবধূর সন্তান জন্মদান সারা দেশের মানুষকে নাড়া দেয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, ২০১৮ সালে সড়কে ৪ হাজার ৭৬ জনের, পরের বছর আরও বেশি ৪ হাজার ৩৫৮ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে প্রাণহানি কিছুটা কমে ৩ হাজার ৫৫৮ জন হয়। অবশ্য ওই বছর করোনার কারণে প্রায় ৬৭ দিন যান চলাচল বন্ধ ছিল। গত বছর সড়কে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৭৬ জনে। চলতি বছর প্রাণহানি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আরও বেশি। তাদের হিসাবে, ২০১৮ সালে সড়কে ৭ হাজার ২২১ ও পরের বছর ৭ হাজার ৮৮৫ জন নিহত হন। ২০২০ সালে প্রাণহানির সংখ্যা কিছুটা কমে হয় ৬ হাজার ৬৮৬ জন। গত বছর প্রাণহানি আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮০৯ জনে।

সড়ক দুর্ঘটনা কীভাবে কমবে

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে সুইডেনকে সবচেয়ে নিরাপদ সড়কের দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

১৯৯৭ সালে সুইডিশ পার্লামেন্ট সড়কে প্রাণহানি শূন্যে নামিয়ে আনতে আইন পাস করে। এ লক্ষ্য অর্জনে দেশটি যানবাহনের মানোন্নয়ন, গতি কমানো, সড়ক উন্নয়ন ও দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় বিপুল বিনিয়োগ করে। সড়কের মাঝের লেন দিয়ে ওভারটেকিংয়ের নিয়ম চালু করে। এতে দুর্ঘটনা ৬৬ শতাংশ কমে যায়।

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকার সড়ক পরিবহন আইন করে। তবে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারার কার্যকারিতা স্থগিত করে। এরই মধ্যে সাজা কমাতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এ দেশে যথাযথ পরীক্ষা না দিয়েই পেশাদার চালক লাইসেন্স পাওয়া পাচ্ছে। চলাচলের অনুপযোগী যানবাহন অবাধে চলছে।

সড়ক আইনের অনিঃশেষ যাত্রা

২০১০ সালে নতুন সড়ক আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১২, ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চার দফা খসড়া প্রণয়ন করা হয়। শুরুতে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যক্তির মৃত্যুর দায়ে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত শাস্তির প্রস্তাব করা হয়। পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের শাস্তি কমানোর চাপ আর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির মুখে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রেখে আইন পাস করা হয়। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর আইন কার্যকর করে সরকার। কিন্তু পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে সচেতনতার কথা বলে আইন প্রয়োগ দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আইনের প্রয়োগ আটকে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত বছর আইনটি আবার সংশোধন করে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মূল দাবি যা যা ছিল

২০১৮ সালের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নয়টি দাবি ছিল। এর কিছু ছিল তাৎক্ষণিক, যার কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু অন্য দাবির কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালাতে না দেওয়ার দাবি পূরণ হয়নি।

গত বছরের নভেম্বরে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান সড়কে নিহত হলে শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলনে নামে। এবার ১১ দফা দাবি পেশ করে। এবারও তাৎক্ষণিক কিছু দাবি বাস্তবায়িত হলেও দীর্ঘমেয়াদি দাবি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সড়কে ট্রাফিক বাতি বসানো, শহরে জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করার দাবির কিছুই হয়নি।

সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নেও গতি নেই

২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচ দফা অনুশাসন দেন। এর মধ্যে দূরপাল্লার চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার নির্মাণ, দূরের পথে বিকল্প চালক রাখা এবং একজন চালককে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না দেওয়া উল্লেখযোগ্য। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণের একটি প্রকল্প নিয়েছে।

২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা একটি কমিটি ওই বছরের আগস্টে ৩০টি সিদ্ধান্ত নেয়, যেগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ১৫ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানীতে গণপরিবহন চলাচলের সময় দরজা বন্ধ রাখা, স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা বন্ধ রাখা, বাসের দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর প্রদর্শনের নির্দেশনার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।

চালকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। কিন্তু বিআরটিএ তিন বছর ধরে ১৫ লাখ চালকের লাইসেন্স আটকে রেখেছে।

ঢাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস শুরু বা ছুটির পর অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট ও বিএনসিসির সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এ নিয়েও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির চিফ হুইপ মসিউর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। আর শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। এর বাইরে অন্তত ৩০ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। জেলা পর্যায়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে সরকারদলীয় নেতারা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব কারণে সরকার পরিবহন খাতে কঠোর আইনের প্রয়োগে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে গেলে শক্তিশালী পরিবহন নেতা-শ্রমিকেরা মাঠে নেমেছেন। সরকারও নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।