এই প্রথম আদালতে কথা বললেন দীপু মনি
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আসামির কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে একটি চেয়ারে বসা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। একপর্যায়ে নিজের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঘড়িতে বেলা একটা বাজতে কিছুক্ষণ বাকি। এজলাসে আসেন বিচারক। তখন আদালতে উপস্থিত সব আইনজীবী দাঁড়িয়ে যান। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান দীপু মনিও। এ সময় বিচারককে সালাম দেন তিনি।
পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আসামি দীপু মনির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং (অর্থ পাচার) প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করছি।’
দুদকের পিপির বক্তব্য শোনার পর দীপু মনি আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার কিছু কথা বলবার রয়েছে।’
আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর দীপু মনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি আজ ১১ মাস ধরে কারাগারে রয়েছি। কারাগারে আমি পত্রিকা পাই। সেই পত্রিকায় বেশ আগে একটি খবর বেরিয়েছিল। সেখানে দেখেছিলাম, আমার নাকি ২৮টি অ্যাকাউন্ট (ব্যাংক হিসাব) রয়েছে। তাতে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক।’
দীপু মনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি একজন নিয়মিত করদাতা। গত ১৫ বছরে আমার আয়-ব্যয়ের সমস্ত হিসাব ওই আয়কর বিবরণীতে জমা রয়েছে। আমার যে ২৮টি ব্যাংক হিসাবের কথা বলা হচ্ছে, সেটি একবারে অসম্ভব। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।’
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি একজন নাগরিক। দেশের নাগরিক হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ জানবার অধিকার আমার রয়েছে। আমাকে অন্ধকারে রেখে দুদক আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।’
দীপু মনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার নিজের ছয়টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয় না। তবে বাকি চারটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন ছিল। আমি দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আমার ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেনের তথ্য জানতে চাই।’
এ সময় দীপু মনির বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম ও মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মাননীয় আদালত, উনি (দীপু মনি) যখন এ মামলায় গ্রেপ্তার হবেন, তখন আইনজীবীর মাধ্যমে এ মামলার সমস্ত কাগজপত্রের অনুলিপি তিনি পাবেন। আর দুদক মামলা করে কাগজপত্র আর নথিপত্রের ভিত্তিতে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় আসামি ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। ব্যাংক হিসাবের সুনির্দিষ্ট তথ্য মামলার কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়।’
পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মামলার তদন্তে দীপু মনির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সমস্ত তথ্য আদালতের কাছে তুলে ধরবে দুদক। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে অনুসন্ধান পর্যায়ে দীপু মনি ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক।’
এ সময় দীপু মনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা। আমি তো কারাগারে আমার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পাচ্ছি না। এই ১১ মাসে আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে বহু আগে দুবার কারাগারে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর যখন আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া হয়েছিল, তখন একবার আমি আমার আয়কর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। এর বাইরে আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কারাগারে কথা বলার কোনো সুযোগ পাচ্ছি না।’
এ সময় আদালত দীপু মনির উদ্দেশে বলেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা নয়।’
দীপু মনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সুনাম অর্জন করতে সারা জীবন চলে যায়। আর নষ্ট করতে সময় লাগে মাত্র দুই মিনিট। আমি আমার মামলা লড়তে চাই। এ জন্য দরকার তথ্য-উপাত্ত। তথ্যই আমার শক্তি।’
সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি আছি কাশিমপুর মহিলা কারাগারে। এই কারাগারে সাক্ষাতের অনুমতি পাওয়াটা কঠিন। গাজীপুরের কাশিমপুরের অন্যান্য কারাগারে বন্দীরা তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন।’
দীপু মনির বক্তব্যের পর আদালত বলেন, আসামি হিসেবে উনি তো আইনগত সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন। যদি তিনি আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পান, তাহলে তো তিনি অনিরাপদ বোধ করবেন।
এ সময় দীপু মনির আইনজীবী মোরশেদ হোসেন আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বাস্তবতা অনেক কঠিন। দেখাসাক্ষাতে আদালতের অনুমতি হয়। কিন্তু অনেক সময়ই দেখাসাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া যায় না।’
আদালত সবার বক্তব্য শোনার পর দুদকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা মামলায় দীপু মনিকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।
প্রায় ৪৫ মিনিট শুনানি শেষে বেলা একটা ৩৯ মিনিটের দিকে দীপু মনিকে আদালতকক্ষ থেকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর বেলা আড়াইটার দিকে দীপু মনিকে হাজতখানা থেকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। পরে প্রিজন ভ্যানটি গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারের উদ্দেশে আদালত চত্বর ছেড়ে যায়। এ সময় প্রিজন ভ্যানের একটি বেঞ্চে দীপু মনি বিমর্ষ হয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে ছিলেন।
দীপু মনির আইনজীবী ফয়সাল গাজী জানান, দীপু মনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর কখনো আদালতে কথা বলেননি। আজ তিনি এই প্রথম আদালতে কথা বললেন।
এ সময় দীপু মনির অভিযোগের বিষয়ে ফয়সাল গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, কী মামলা আছে, সেসব কাগজপত্র আমরা পাচ্ছি না। কারাগারে গিয়েও আমরা ঠিকমতো সাক্ষাৎ পাচ্ছি না।’
তবে দীপু মনি এবং তাঁর আইনজীবীর এসব বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোছা. কাওয়ালিন নাহার। আজ বুধবার বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারাগারে কোনো বন্দী যদি আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ চান, অবশ্যই উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে তিনি দেখা করতে পারেন। বন্দীর প্রকৃত আইনজীবী হিসেবে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁকে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়।’
সিনিয়র জেল সুপার কাওয়ালিন নাহার আরও বলেন, ‘কেন আসামি দীপু মনি আদালতে দাবি করেছেন, আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়া কঠিন, সেটি তিনি ভালো বলতে পারবেন। আমি বলতে পারি, আমার কারাগারের প্রথম শ্রেণির কারাবন্দীরা প্রতিনিয়ত নিজের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। দীপু মনির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কয়বার তিনি আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ চেয়েছেন, সেটি নথিপত্র না দেখে বলা সম্ভব নয়।’
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় আট কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি ও তাঁর স্বামী তাওফিক নেওয়াজের বিরুদ্ধে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, দীপু মনির বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৯২ লাখ ২ হাজার ৫৩০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। তাঁর ২৮টি ব্যাংক হিসাবে ৫৯ কোটি ৭৯ লাখ ৯২ হাজার ৭৩১ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে।
দুদক বলছে, স্ত্রীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে তাওফিক ১ কোটি ৯৬ লাখ ৩৯ হাজার ২০৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তাওফিকের বিরুদ্ধে করা মামলায় তাঁর স্ত্রী দীপু মনিকেও আসামি করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৯ আগস্ট দীপু মনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। কয়েকটি হত্যা মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।